সন্দেশখালি থেকে আরজি কর, বার বার অস্বস্তি! ‘সংগঠিত অপরাধ’ রুখতে বিশেষ সেলের ভাবনা
আনন্দবাজার | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
‘সংগঠিত অপরাধ’ নিয়ন্ত্রণে অতীতে একাধিক বার বার্তা দিয়েছে রাজ্য সরকার। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, মহারাষ্ট্রের মতো এ রাজ্যেও ‘অরগানাইজ়ড ক্রাইম কন্ট্রোল’ (ওসিসি) নামে একটি বিশেষ সেল সক্রিয় করার পরিকল্পনা নিয়ে জোর চর্চা চলছে প্রশাসনের অন্দরে। যা থাকার কথা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। আধিকারিকদের একাংশের দাবি, বাংলাদেশ-পরিস্থিতির পরে এমন অভ্যন্তরীণ সুরক্ষাকবচ জরুরি। সমান্তরালে অনেকে এ-ও মনে করছেন, সন্দেশখালি থেকে আর জি কর আন্দোলন— বারে বারে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে রাজ্যকে। জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন রাজপথে আপাতত না থাকলেও, যে কোনও সময়ে তা ফের ফেটে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়ে এমন পরিকল্পনার চর্চা অর্থবহ।
প্রবীণ আধিকারিকদের একাংশ দাবি করছেন, পুলিশের এমন কোনও সেল অতীতে ছিল কি না, তা তাঁরা মনে করতে পারছেন না। ফলে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতেই এমন সেলের প্রয়োজন অনুভূত হল কি না, তা-ও এসেছে চর্চায়। যদিও সরকারি ভাবে এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে চাননি। ফোন ধরেননি মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। তিনি জবাব দেননি সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন নিয়ে পাঠানো মোবাইল বার্তারও। পুলিশের এক কর্তার কথায়, “বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।” অপর এক কর্তার দাবি, “মহারাষ্ট্রে কন্ট্রোল অব অর্গানাইজ়ড ক্রাইম অ্যাক্ট রয়েছে। তবে এ রাজ্যে এমন কোনও আইন নেই এখনও।”
পুলিশের একাংশ জানাচ্ছে, সাধারণ ভাবে ‘সংগঠিত অপরাধ’ বলতে বোঝায় এক বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা সুপরিকল্পিত ভাবে কোনও অপরাধ সংগঠিত হওয়া। তা জঙ্গি তৎপরতা, নাশকতা, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি নিয়ে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা ইত্যাদি নানা ধরনের হতে পারে। ফলে প্রশাসনকে আগে থেকে সতর্ক থাকতে হয়। তার মূল মন্ত্র গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং তার ভিত্তিতে সূত্র একত্রিত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য প্রতিহত করা। আবার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য রাখাও অন্যতম কৌশল।
সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্দেশখালি বা আর জি কর-কাণ্ডের পরে হওয়া আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত বলেই মনে করে সমাজের বিভিন্ন মহল। কিন্তু এ সবের নেপথ্যে উস্কানি ছিল বলেই মনে করা হচ্ছে প্রশাসনিক ভাবে। এমনকি, ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে’ সমর্থন জানিয়েও সরকারি ভাবে দাবি করা হয়েছিল, জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের নেপথ্যে কোনও শক্তির ইন্ধন রয়েছে। প্রাক্তন এক কর্তার কথায়, “অপরাধের সংজ্ঞা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন হতেই পারে। রাষ্ট্র কী ভাবে তা দেখছে, তার ভিত্তিতেই প্রশাসনিক পদক্ষেপ হয়।”
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই জানাচ্ছেন, অতীতে বহু বার গোয়েন্দা তথ্য সময়মতো না-পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে। গোয়েন্দা বিভাগকে শক্তিশালী করতে পদক্ষেপের নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেও রাজ্যের নানা প্রান্তে বিক্ষিপ্ত ভাবে সরকারবিরোধী অনেক প্রতিবাদের আঁচ সময়মতো সরকার পায়নি বলেই অভিযোগ। বাংলাদেশে পরিস্থিতি বদল হওয়া বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্যের খামতিও কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ, সে দেশের নিকটতম প্রতিবেশী এ রাজ্যই।
আর জি কর-কাণ্ডের পরে নাগরিক সমাজ এবং জুনিয়র চিকিৎসকদের টানা আন্দোলন সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। কলকাতা পুলিশের সদর দফতরে প্রতীকী শিরদাঁড়া সামনে রেখে, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের হাতে তাঁরই ইস্তফা সম্বলিত দাবিপত্র তুলে দেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনাও সরকারের অস্বস্তি বাড়ায় বহু গুণ। পরে পদ থেকে তাঁকে সরিয়েও দিতে কার্যত বাধ্য হয় সরকার। এ ভাবে পরিস্থিতি বদলাবে এবং আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়া প্রায় পুরোপুরি মেনে নিতে হবে, এমন ধারণা সরকারের শীর্ষমহলেরও সম্ভবত ছিল না।
প্রসঙ্গত, বিনীতকে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের দায়িত্বে ফের এনেছে রাজ্য সরকার। জ্ঞানবন্ত সিংহকে রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগের (আইবি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। চার জন জুনিয়র আইপিএস অফিসারকে এসডিপিও পদ থেকে বদলি করা হয়েছে আইবি-তে। ২০২৬ সালে রাজ্যে বিধানসভা ভোট হবে। অভিজ্ঞ কর্তাদের একাংশ মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সক্রিয় হলে ওসিসি এবং পুলিশের এই দুই শাখার সম্মিলিত ভূমিকা আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।