প্রতিবাদ থাকুক, কিন্তু পুজো বানচালে হঠাৎ সক্রিয় কারা?
প্রতিদিন | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
অপরাজিতা সেন: আর জি কর কাণ্ডে আমরা সবাই ধর্ষক, খুনি, ষড়যন্ত্রকারী এবং প্রমাণ লোপাটকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। সিবিআই এখন তদন্তের দায়িত্বে। মামলা দেখছে সুপ্রিম কোর্ট। ন্যায় বিচারের দাবি আমাদেরও, এবিষয়ে জুনিয়র ডাক্তার এবং নাগরিকদের আন্দোলনকে আমরা সমর্থনও করি। কিন্তু সিপিএম বা বিজেপি, যেসব রাজনৈতিক দলের জমানায় এধরনের ঘটনা ভূরি ভূরি, বা এদের লেজুড় অন্য কোনও রাজনৈতিক সংগঠন এবিষয়ে অরাজনীতির মুখোশ পরে অরাজকতা তৈরি করতে চাইলে, আমরা এই অংশটুকুর বিরোধিতা করছি।
আর এখানেই লক্ষণীয়, পরিকল্পিতভাবে এই প্রতিবাদের আবেগকে বিপথে চালিয়ে পুজো, মহালয়া, উৎসব-অর্থনীতির পরিবেশটা নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এর পিছনে মূলত বাম ঘরনার কিছু শক্তি। আর উদ্দেশ্য যেহেতু তৃণমূল সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলা, তাই তাতে মদত বিজেপি, কংগ্রেস-সহ আরও কিছু রাজনৈতিক শক্তির।
কিছু তথাকথিত অরাজনৈতিক ব্যক্তির, যাঁরা ঘোরতর রাজনৈতিক এবং তৃণমূলবিরোধী, তাঁদের বিবৃতি এবং সোশাল মিডিয়ার পোস্টগুলো দেখুন। প্রথম পর্যায়ে বলা হল, আর জি করের প্রতিবাদে পুজো নয়, উৎসব নয়। উৎসবে ফিরব না, ভাইরাল হল। দ্বিতীয় পর্যায়ে বলা হল, বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি, পুজো বন্ধ হোক। পোস্ট চলছে, রাজ্যের অনুদান ফেরান। এরপর এখন শুরু হয়েছে, মহালয়ায় রাত দখল, ভোর দখল, দিনভর মিছিল, মিটিং। উদ্যোক্তারা বলছেন, মহালয়ার আগেরদিন এক লক্ষ, মহালয়ার দিন দু’লক্ষ মানুষের জমায়েত করাবেন। শেষপর্যন্ত কতজন হবে, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, টার্গেট মহালয়া। বাংলায় এক তাৎপর্যপূর্ণ তিথিকে ঘিরে একটি আবেগকে অন্য উদ্দেশ্যে বিভ্রান্তিকরভাবে ব্যবহার। মহালয়া নষ্ট কর, ছবি হবে, খবর হবে। পুজোর সময়ও নানা কর্মসূচি। প্রশ্ন হল, প্রতিবাদ থাকবে। কিন্তু পুজো এবং উৎসবকে বানচাল করার ধারাবাহিক চেষ্টা করে যাচ্ছে কারা? যেসব টিভি চ্যানেল এবং কাগজ উগ্রভাবে ‘উৎসবে’ ফিরব না-র প্রচারক, তারা তো পুজোর বিজ্ঞাপনে নিজেদের ভরিয়ে তুলে রোজগারের কিছু বাকি রাখছেন না। এমনকী, সিপিএমের ‘গণশক্তি’ শনিবার প্রথম পাতায় জ্যাকেট করে জুতোর বিজ্ঞাপন ছেপেছে, যার স্লোগান হল ‘দুর্গাপুজো উদ্যাপন করুন গৌরবের সাথে’। যারা উৎসবে জল ঢালতে মানুষের আবেগকে উসকানি দিচ্ছে, তারা এক পয়সা ছাড়ছে না। কিন্তু অস্থিরতা তৈরির প্রচারটা সেরে যাচ্ছে। যে সিপিএম পুজো মানে না অথচ প্যান্ডেলের পাশে স্টল করে বই বেচে, তারাও বকলমায় নেমেছে মহালয়ার আগের রাত থেকে অস্থিরতা তৈরিতে। পুজো-অর্থনীতিতে বিরাট সংখ্যক ছোট-বড় ব্যবসায়ী জড়িত, এরা তাঁদের স্বার্থ দেখছে না। মহালয়ায় সকালে পিতৃতর্পণ করতে কত মানুষ গঙ্গামুখী হন, এবার রাস্তায় টুকরো টুকরো লোক জমা করে যানজট তৈরির পরিকল্পনা। এসব হচ্ছেটা কী? সিপিএমের সাঙ্গোপাঙ্গদের ফেসবুক পোস্ট দেখলে মনে হয়, এরা ধোয়া তুলসীপাতা, মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছে, এদের জমানায় খারাপ কিছু ঘটেনি। অথচ সবরকম খারাপ ঘটনার ধারকবাহক হল সিপিএম জমানা। এখনও কেরলে সিপিএম বিধায়কের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ এবং আইনি ব্যবস্থা হচ্ছে। এরা নির্বাচনে পরাজয়ের গ্লানি হজম করতে পারছে না, নিজেদের পতাকা প্রত্যাখ্যাত, তাই নাগরিক ছদ্মবেশে অন্য কিছু মানুষের আবেগকে বিভ্রান্ত করে পুজোর সময় অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বক্তব্য স্পষ্ট। আর জি করে দোষীরা শাস্তি পাক। কেউ যেন ছাড় না পায়। এই ঘটনায় মানুষ বিরক্ত। কিন্তু এর সঙ্গে পুজোকে জড়াতে সাধারণ মানুষ রাজি নন। শুধু কলকাতা শহরের হিসাবে এবার পুজোর সংখ্যা ২৯৭৬। এবার ২১৯টি পুজো বেশি হচ্ছে। কিছু রাজনৈতিক কারণে আট-দশটি পুজো কমিটি সরকারি অনুদান ফেরানোর কথা বলেছে এবং সেজেগুজে ছবি তুলে বিবৃতি দিয়েছে। উল্টোদিকে, তার অন্তত দশগুণ কমিটি এবার নতুন করে অনুদানের আবেদন করেছে। পুজো-অর্থনীতির সঙ্গে যে বিপুল কর্মসংস্থান এবং আয় জড়িত, তাঁরা মনপ্রাণ দিয়ে চাইছেন প্রতিবাদ প্রতিবাদের মতো থাকুক, অন্যদিকে এই অর্থনীতি থাকুক সচল। যাঁরা সব নিয়ে নেতিবাচক প্রচার করছেন, লক্ষ করে দেখবেন, তাঁরা নিজেরা কিছু ছাড়ছেন না, কোনও না কোনওভাবে তাঁদের সব কিছু পুষিয়ে যাচ্ছে। শুধু সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই পরিকল্পিত প্রচার। যখন বাম জমানায় কোচবিহারের নার্স বর্ণালী দত্ত, বানতলায় ডাক্তার অনিতা দেওয়ান ধর্ষণ এবং খুন হন, এই তালিকা দীর্ঘ, তখন কোথায় ছিল এই তথাকথিত বামপন্থী এবং নাগরিকদের একাংশের বিপ্লব? যখন অন্য রাজ্যে এখনও চলছে কুৎসিত ঘটনা, প্রাণহানি, তখন এদের বিবেক কী বলে? এখন টার্গেট হচ্ছে বাংলা এবং এখানকার বর্তমান সরকার। তাই অঙ্ক কষে একাধিক পরাজিত, প্রত্যাখ্যাত শক্তি তিলোত্তমার ঘটনাকে রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে এবার পুজো ডিস্টার্ব করতে নেমেছে। আমরাও দোষীদের শাস্তি চাই, কিন্তু মহালয়ার রীতি বা পুজো-অর্থনীতির ক্ষতি করে নয়। সমাজে বহু ভালো কাজ হচ্ছে। সেগুলির তো প্রচারই হয় না। আবার সামাজিক অপরাধও কিছু ঘটছে, অবাঞ্ছিত, শাস্তি চাই। এসব অপরাধ বন্ধ করা দরকার। কিন্তু তাই বলে যারা নাকি পুজোয় বিশ্বাস করে না, যারা নাকি নাস্তিক, বকলমে তারা পিছন থেকে আবেগ উসকে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন, সেটাও বরদাস্ত করা উচিত নয়। যেহেতু স্পর্শকাতর বিষয়, সরাসরি তৃণমূলের পক্ষে এদের এইসব অপচেষ্টার বিরোধিতা করা আপাতভাবে দৃষ্টিকটু, শাসক দল সংযত থাকছে। সেই সুযোগে এবং আজকের দিনে মিডিয়া, সোশাল মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে কিছু অপশক্তি এবার পুজোর পরিবেশ নষ্ট করে বাংলা এবং সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলার ছক কষেছে। এই গোলমালকারীরাই শুধু বিচার চায়, আর যাঁরা পুজো করছেন, তাঁরা বিচার চান না, এই ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করে বিপ্লবী সাজছেন কেউ কেউ।
কমরেডদের জিজ্ঞাসা করুন, তাদের সময়ে যতগুলি ধর্ষণ, খুন, নারীহত্যা এমনকী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনীষা মুখোপাধ্যায়ের রহস্যময় অন্তর্ধান, এর একটারও সদুত্তর এঁরা দিতে পারবেন? বাংলার এই মরশুমটা একদিকে যেমন ধর্মের আচার, একদিকে শিল্প-সংস্কৃতির যজ্ঞ, অন্যদিকে রাজ্যের তথা দেশের বৃহত্তম অর্থনীতি। এই সময়ে বেসুরো লম্ফঝম্ফ করলে প্রচার হবে, ছবি উঠবে, নিজেদের কিছু বিচিত্র সংগঠনের বিপ্লবী ইমেজের মার্কেটিং হবে, তার সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত, কিছু সংগঠন আবার আন্দোলনের নামে তহবিল সংগ্রহ করবে। ফলে যারা ভোটের ময়দানে জনগণের দরবারে হালে পানি পাচ্ছে না, তারা স্রেফ উপস্থিতির ছাপ ফেলার জন্য পুজোয় গোলমালের, নানা নাটক করার, পুজোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সস্তা রাজনীতি প্রোমোট করার জন্য শকুনের দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এরসঙ্গে আসল ন্যায়বিচারের আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই। যে সিপিএম মুখে বলে উৎসবে নেই, আন্দোলনে আছি; আর ‘গণশক্তি’তে টাকা নিয়ে বিজ্ঞাপনে বড় করে লেখে, ‘সগর্বে পুজোর উৎসবে থাকুন’, তাদের মায়াকান্নায় বিভ্রান্ত হয়ে পুজোর পরিবেশ নষ্ট হতে দেবেন না। তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের দাবিতে আসুন সবাই সরব থাকি, তিলোত্তমাদের জন্য সমাজকে সাধ্যমতো সচেতন করি; সমাজ-অর্থনীতির যে অংশের উপর বিপুল মানুষ নির্ভরশীল, আসুন, সেগুলিকেও সচল রাখি।