বাবার ছোটখাটো মুদিখানার দোকান। হুগলির চণ্ডীতলা থেকে তিনি ডাক্তারি পড়তে কল্যাণীর জেএনএম মেডিক্যালে যখন এসেছিলেন, তখন নিতান্তই অস্বচ্ছল অবস্থা। কিন্তু কয়েক বছরে সেই ছাত্রের জীবনযাত্রা দেখে অবাকই হন সহপাঠীরা। ইন্টার্নশিপে মাত্র ২৯ হাজার টাকার মাসিক স্টাইপেন্ড। অথচ তাঁর পকেটেই আইফোন, হাতে আই-ওয়াচ দেখে উঠতে শুরু করেছিল প্রশ্ন।এখন তিনি প্রথম বর্ষের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া। মাসিক স্টাইপেন্ড ৪৯ হাজার টাকা। কল্যাণীতে একটি ১৪০০ বর্গফুটের থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাট এবং একটি হাইব্রিড মডেলের টাটা নেক্সন গাড়ির মালিক তিনি। বর্তমান আবহে তাঁর বিলাসবহুল জীবন জন্ম দিয়েছে বহু প্রশ্নের।
একই রকম বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এসএসকেএমের এক সদ্যপ্রাক্তন হাউসস্টাফেরও। তাঁর পরিবার অবশ্য অস্বচ্ছল নয়। যদিও সতীর্থদের প্রশ্ন, কতটা স্বচ্ছল হলে একজন হাউসস্টাফ কী করে মাসিক ৪৯,৮০০ টাকায় আইফোন-১৪ ম্যাক্স প্রো, একটি এক্সইউভি-৭০০, একটি আই-১০, একটি বুলেট ও একটি ইয়ামহা সুপার-বাইকের মালিক হতে পারেন!
তালিকাটা লম্বা। এবং এঁদের সকলের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে তথাকথিত থ্রেট কালচারে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। শুধু ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করাই নয়, ডাক্তারি পড়ুয়া ও জুনিয়র ডাক্তারদের উপর নানা রকম চাপ সৃষ্টি করে টাকা তোলাও এঁদের কাজের অঙ্গ বলে অভিযোগ। এঁদের অধিকাংশেরই সরকারি উপার্জন যেমন আহামরি কিছু নয়। নিছক পড়ুয়ারা এখনও খাতায়কলমে উপার্জন শুরুই করেননি। এঁদের পরিবারও যে বেশ ধনী, সেরকম কোনও তথ্য নেই সহপাঠীদের কাছে।
অভিযোগ, স্রেফ চমকে, ধমকে, হুমকি দিয়ে তোলা টাকায় কয়েক বছরেই পাল্টে যায় এঁদের জীবনযাত্রা। হাতে কাঁচা টাকার কোনও অভাব নেই। এবং তার প্রতিফলন সাফ দেখা যায় তাঁদের জীবনযাত্রায়। পুর্ণমাত্রায় ডাক্তার হয়ে ওঠার আগেই হয়ে ওঠেন ‘তোলাবাজ’। ঠিক যেমন ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
আরজি করের ঘটনা বহু ঘটনাকে সামনে এনে ফেলেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এই থ্রেট সিন্ডিকেট। অভিযোগ, তার সদস্য ডাক্তারি পড়ুয়া থেকে শুরু করে ইন্টার্ন, হাউসস্টাফ, পিজিটি-দের হাতে হাতে আজকাল অ্যাপল-ওয়াচ, আইফোনের লেটেস্ট ভার্সন মডেল, শেয়ার মার্কেটে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ, ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট, গ্যারাজে হাই-এন্ড সেডান, এসইউভি দেখে বিস্মিত মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র ডাক্তাররাও।
এসএসকেএমের এক ইন্টার্ন তাঁর এক সতীর্থ-সহপাঠী সম্পর্কে বলছিলেন, ‘বছর দুয়েক আগে যখন আমরা তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া, তখন দেখেছিলাম, ওর প্রায় ৭ লাখ টাকার বিনিয়োগ রয়েছে শেয়ারে। তার এক বছর আগে থেকেই ও থ্রেট সিন্ডিকেটের মেম্বার। এখন বিনিয়োগের অঙ্কটা কোথায় পৌঁছেছে, জানি না।’
আরজি করের এক চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়া জানাচ্ছেন, তাঁর এক সহপাঠী দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই থ্রেট সিন্ডিকেটর সদস্য। তৃতীয় বর্ষের শেষের দিকে আরজি করে যে ফেস্ট হয়েছিল, তার জন্য বিপুল টাকা চাঁদা তোলা হয়েছিল। বিভিন্ন বর্ষ অনুযায়ী গড়ে ৩-১০ হাজার টাকা। ওই ফেস্টের পরেই ওই পড়ুয়াকে একটা লাক্সারি হ্যাচ-ব্যাক গাড়ি কিনতে দেখে খানিকটা অবাকই হন সহপাঠীরা। সদ্য এমবিবিএস পাশ চিকিৎসকদের একাংশের হাতে এত টাকা দেখে চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাজীব পাণ্ডে কিংবা কমিউনিট মেডিসিনের শিক্ষক-চিকিৎসক অনির্বাণ দোলুইরাও বিস্মিত!
রাজীব বলছেন, ‘২০০২-এ যখন আমরা ডাক্তারি পাশ করেছিলাম, তখন ইন্টার্নশিপের স্টাইপেন্ড থেকে একটা মোবাইল কিনতে পারলেই মনে হতো দুনিয়ার সবচেয়ে দামি জিনিস কিনে ফেলেছি। আর এখনকার অনেক ইন্টার্ন তো একেবার গাড়ি-বাড়ি করে ফেলছে দেখছি! থ্রেট সিন্ডিকেটের অশুভ আঁতাত ছাড়া এত হিসেব বহির্ভূত টাকা হাতে আসার কথা নয়।’ অনির্বাণ আবার ভেবেই পাচ্ছেন না, কী ভাবে এত টাকা ‘আয়’ করছেন সরকারি-বেসরকারি চাকরি বা প্র্যাকটিস শুরু না-করা নব্য চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁর সন্দেহ, থ্রেট সিন্ডিকেটের অসাধু উপায় ছাড়া এমনটা হতে পারে না।
বর্ধমান মেডিক্যালের এক স্নাতকোত্তর পড়ুয়া (পিজিটি) ব্যাখ্যা করে জানাচ্ছেন, কী ভাবে থ্রেট কালচারের অঙ্গ হয়ে উঠলে হাতে প্রভূত টাকা আসা সম্ভব সহজেই। তিনি বলেন, ‘ধরুন একটা ইভেন্টের জন্য কার্যত গা-জোয়ারি করে গড়ে ৪ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হলো। একটা ছোট মেডিক্যাল কলেজেও অন্তত ১২৫ জন এমবিবিএস পড়ুয়া থাকেন।
অর্থাৎ, একটি ব্যাচ থেকেই ৫ লাখ টাকা আমদানি। পাঁচটি ব্যাচ মেলালে অঙ্কটা দাঁড়ায় ২৫ লাখ টাকা। সেই টাকার একটা সামান্য অংশ ইভেন্টের জন্য খরচ করে বাকিটা ভাগাভাগি করে নেয় ১০-১২ জনে। এ ছাড়াও সরস্বতী পুজো, দোলের উৎসব, বিজয়া সম্মিলনী, বড়দিন কিংবা নানা ধরনের অ্যাকাডেমিক অ্যাক্টিভিটি— এমন ইভেন্ট বছরে ১০-১২টা লেগেই থাকে।’