এই সময়: আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের মামলায় আজ, সোমবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানির দিকে চেয়ে আন্দোলনকারীরা। তাঁদের সঙ্গে পথে-নামা বহু সাধারণ মানুষেরও উৎসাহও রয়েছে এই শুনানিকে ঘিরে। সূত্রের খবর, সকালের জায়গায় সোমবার দুপুরে শুনানি হওয়ার কথা। আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের হয়ে আজই প্রথম সেই শুনানিতে অংশ নেবেন ইন্দিরা জয় সিংহ। তাঁর মতো দুঁদে আইনজীবীর সওয়ালের দিকেও তাকিয়ে সকলে। ঘটনার পর থেকে তথ্যপ্রমাণ নষ্টের গুরুতর অভিযোগ উঠে এসেছে। আর উঠেছে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিও।নিহত তরুণীর বিচারের পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের অন্যতম মূল দাবি ছিল চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা। আর সেই প্রশ্নেই শুক্রবার প্রথমে সাগর দত্ত ও পরে রবিবার ন্যাশনাল মেডিক্যালের ঘটনায় রাজ্যের প্রতিশ্রুতি জোর ধাক্কা খেল বলে জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি। উল্লেখ্য, রবিবার ভোরে রোগী-পরিজনের হামলার কবলে পড়েন ন্যাশনাল মেডিক্যালের সার্জারি ইমার্জেন্সির চিকিৎসকরা।
অভিযোগ, এক মদ্যপ রোগী ও তাঁর পরিবারের হাতে আক্রান্ত হন জুনিয়র ডাক্তাররা। চলে আশ্রাব্য গালিগালাজ। প্রাণে মারার হুমকিও দেওয়া হয়। এ নিয়ে থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। পাশাপাশি এ দিনই আরজি কর হাসপাতাল পরির্দশন করতে দেখা গিয়েছে কলকাতা পুলিশের সদ্য নিযুক্ত কমিশনার মনোজ ভার্মাকে।
সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার চতুর্থ শুনানির প্রাক্কালে হাসপাতালে সুরক্ষার ফাঁক-ফোকর নিয়ে রাজ্য সরকার চাপে থাকবে বলেই মনে করছেন আইনজীবীরা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার দাবিতে শনিবার রাজ্য সরকারকে মাত্র দু’দিন সময় দিয়েছিলেন আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা। রাজ্যজুড়ে ফের পূর্ণ কর্মবিরতির পথে তাঁরা হাঁটবেন কি না, তা সু্প্রিম শুনানির পরেই সন্ধ্যায় তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
শীর্ষ আদালতে প্রথম তিন বার শুনানির সময়ে দিনের শুরুতেই শোনা হয়েছে আরজি কর মামলা। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। সোমবার দুপুর ২টোর সময়ে ৪২ নম্বরে আরজি কর মামলাটি উঠবে শুনানির জন্য। শুনবে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চ। এই মামলায় প্রায় ৪২টি পক্ষের নথিভুক্ত আইনজীবীর সংখ্যা ২০০-রও বেশি। এর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানির দিন ঠিক করা থাকলেও রাজ্যের আর্জিতেই তা তিন দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর তৃতীয় শুনানির দিনও রাজ্য সরকারকে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিল সু্প্রিম কোর্ট। এর মাঝে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ নিরাপত্তা সংক্রান্ত আশ্বাসের উদ্দেশে স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা দিয়ে চিঠি দেন। তার জেরেই কিছুটা সন্তোষপ্রকাশ করে আংশিক কর্মবিরতি তুলে নেন জুনিয়র ডাক্তাররা। যোগ দেন ইমার্জেন্সি এবং এসেন্সিয়াল পরিষেবায়।
তার পর ধীরে হলেও সিসিটিভি ক্যামেরা এবং বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে মহিলা কনস্টেবল-সহ অতিরিক্ত পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা হয়েছে আরজি কর-সহ প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজেই। রাজ্যের প্রাক্তন ডিজিপি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের নেতৃত্বে সিকিউরিটি অডিটও শুরু হয়েছে। এক-একটি হাসপাতালের সুরক্ষার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কলকাতার এসি ও ডিসি পদমর্যাদার অফিসারদেরকে। কিন্তু এত কিছুর পরেও শীর্ষ আদালতে চতুর্থ শুনানির আগেই ফের রাজ্য সরকারের মুখ পুড়ল পর পর দু’টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সরা আক্রান্ত হওয়ায়।
শুক্রবার জুনিয়র ডাক্তার ও নার্সরা প্রহৃত ও নিগৃহীত হন কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতালে। তার পর থেকেই সেখানকার জুনিয়র ডাক্তাররা আংশিক কর্মবরিতি থেকে ফের পূর্ণ কর্মবিরতিতে চলে যান। জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের তরফে জানানো হয়, গোটা রাজ্যজুড়েই একই পথে হাঁটা হবে কি না, তা সোমবার পর্যন্ত রাজ্যের পদক্ষেপ দেখার পরে তারা সিদ্ধান্ত নেবে।
আর এ দিন ভোরে, হাতে গভীর ক্ষত নিয়ে এক মদ্যপ রোগী ও তাঁর পরিজন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে যান। হাতের ক্ষত গভীর হওয়ায় জরুরি বিভাগের জুনিয়র ডাক্তাররা বলেন, একটা ছোট অপারেশন করতে হবে। কিন্তু রোগীর দাবি, অপারেশন করা যাবে না, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলা হয় চিকিৎসকদের তরফ থেকে। এর পরই শুরু হয় গণ্ডগোল ও হুমকি। অভিযোগ, পুলিশ অনেক পরে আসলেও নিষ্ক্রিয় ছিল। গোটা ঘটনায় নিরাপত্তার অভাবে ভুগছেন চিকিৎসকরা। সার্জারি ইমার্জেন্সিতে ওই ঘটনার সময়ে ছিলেন পাঁচ জন ইন্টার্ন। ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসারের তরফে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বেনিয়াপুকুর থানায়। অভিযুক্ত তিলজলার বাসিন্দা সামসউদ্দিন হোসেন এবং সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
যদিও নিরাপত্তার ব্যাপারটি যে রাজ্য সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দেখছে, তা প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা এ দিন দুপুরেও দেখা গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে শুনানির ঠিক আগের দিন রবিবার হঠাৎ আরজি কর হাসপাতাল পরিদর্শন করতে যান কলকাতার নগরপাল মনোজ। ১৭ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন একবার। আর এ দিন জরুরি বিভাগ এবং প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগেও ঢুকতে দেখা যায় কলকাতার সিপি-কে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আরজি কর হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে রয়েছেন সিআইএসএফ জওয়ানেরা। তাঁদের সঙ্গেও এ দিন কথা বলেন মনোজ।
হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে তার মধ্যেও সরব হয়েছেন চিকিৎসকদের একাংশ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মেডিক্যাল কলেজ এবং সরকারি হাসপাতালগুলিতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। যদিও তা নিয়ে এখনও অভিযোগ উঠছে। পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন কোথায় কোথায় যথাযথ নজরদারির ফাঁক-ফোকর রয়েছে, কোথায় আরও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর প্রয়োজন রয়েছে, তা খতিয়ে দেখেন কলকাতার সিপি।