সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০৫০ মিটার উঁচুতে উত্তরাখণ্ডে রুদ্রপ্রয়াগের কনকচৌরির ঘন অরণ্যে ঢাকা পাহাড়ের মাথাতেও আর জি কর কাণ্ড নিয়ে বিচারের আর্তি দেখে থমকেই যেতে হল!
প্রশ্নটি করেছেন স্থানীয় এক মহিলা, মঞ্জুদেবী। চায়ের দোকান চালান। কলকাতার আর পাঁচটি মা যেমন আর জি কর কাণ্ডে মৃত চিকিৎসকের বিচার চেয়ে সরব, একই ভাবে উন্মুখ মঞ্জুও। বাঙালি পর্যটক দেখলেই জনে-জনে জানতে চান, সত্যিই কি সঠিক বিচার পাবে চিকিৎসক মেয়েটি? না কি কোহরা যেমন রুদ্রপ্রয়াগের ওই অরণ্যকে ঢেকে দেয়, তেমনই কুয়াশার গাঢ় আচ্ছাদনে আগামী দিনে পথ হারাবে ন্যায়বিচার?
দাঁড়িয়ে আছি, রুদ্রপ্রয়াগ ফরেস্ট ডিভিশনের অগস্ত্য মুনি ক্ষেত্রে। সামনে খাড়া পাহাড়ের শেষ প্রান্তে কার্তিকস্বামী মন্দির। অধিকাংশ সময়ে মেঘের আবডালে থাকে এই মন্দির। কিন্তু মেঘ সরে গেলেই মন্দিরকে কেন্দ্র করে দু’পাশে মাথা ঘোরালে চোখে পড়ে তুষারাবৃত চৌখাম্বা, কেদারনাথ, ত্রিশূল, নন্দাদেবী— সারি সারি উচ্চশির। কনকচৌরি গ্রাম থেকে পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে ৩ কিলোমিটার ট্রেকিং-এর শেষে ক্রৌচ পাহাড়ের মাথায় কর্তিকস্বামী মন্দির। দর্শন শেষে মন্দিরের ৪৩৫টি সিঁড়ি বেয়ে সদ্য নেমে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলাম একেবারে প্রথম দোকানটির চত্বরে। বাংলায় কথাবার্তা শুনে গুটিগুটি এগিয়ে এলেন দোকানের মালকিন মঞ্জু। বছর পঁয়ত্রিশের মহিলার মুখে সলজ্জ হাসি লেগে রয়েছে সর্বদা। আমাদের ৮ জনের দলটির উদ্দেশে জানতে চাইলেন, “সত্যিই কি বিচার পাবেন ওই চিকিৎসক? না কি তথ্য প্রমাণ সব লোপাট করে দেওয়া হয়েছে?”
বোঝা গেল, কেবল মৃতার বাবা-মা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারাই নন, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে মরিয়া মঞ্জুর মতো আরও অনেকেই। আর জি করের নির্যাতিতার ন্যায়বিচারের আর্জির শরিক তাঁরাও।
রুদ্রপ্রয়াগের পাহাড়ের মাথায় সংরক্ষিত এলাকা বলে বিদ্যুৎ সংযোগ সে ভাবে নেই। মোবাইলের টাওয়ারই ভরসা। মোবাইলে ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে কলকাতার চিকিৎসক মেয়ের উপর হওয়া নির্যাতনের ঘটনা জেনেছেন মঞ্জু। জেনেছেন কী ভাবে তথ্য-প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে, কন্যার জন্য বিচার চেয়ে আমজনতা যে প্রতিদিন পথে নামছেন, সেই খবরও পৌঁছে গিয়েছে হিমালয়ের প্রান্তিক ওই কোণে, মঞ্জুদেবীদের গোচরে। অন্তরের টানে তাঁরাও শরিক হয়েছেন সেই দাবির— ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’
কার্তিকস্বামী মন্দিরে বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের বড় অংশই বাঙালিরা। এ ছাড়া দক্ষিণ ভারত থেকে ভক্তরা আসেন কার্তিকেয়র পুজো দিতে। করোনার পর থেকে উত্তরাখণ্ড সরকার পর্যটনের উন্নতিতে উৎসাহ দেওয়ায় ধীরে ধীরে পর্যটকদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে কনকস্বামী মন্দির। মন্দিরে ওঠার মুখে খান পাঁচ-সাত দোকান, যার মধ্যে নামার পথে প্রথমটিই মঞ্জুদেবীর। ৪ বছর আগে দোকান দিয়েছেন তিনি। মঞ্জু বলেন, “আমাদের অধিকাংশ পর্যটক বাঙালি। তাই বাংলার মানুষের প্রতি আমাদের আলাদা ভালবাসা রয়েছে। কলকাতার খবর তাই একটু বেশি রাখি আমরা।”
দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (এখন অবশ্য দিল্লিতেও মহিলা মুখ্যমন্ত্রী) তাই বাড়তি শ্রদ্ধা করতেন মঞ্জু। কিন্তু আর জি করের ঘটনার পরে ক্ষোভের পর্বত উগরে দিলেন তিনি। মঞ্জু বলেন, “এক জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর রাজ্যে যে ভাবে ওই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তা দেখে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছি! ভীষণ রাগ হয়েছিল জানেন? কিন্তু রাগ দেখানোর কোনও জায়গা তো নেই। তাই আপনাদের মতো বাঙালি পর্যটকদের কাছে জানতে চাই, মেয়েটি কি সত্যিই বিচার পাবে?” কথাবার্তায় তত ক্ষণে যোগ দিয়েছেন আশেপাশের দোকানি ও কর্মীরাও। তাঁদের সম্মিলিত বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের এই ঘটনা দেখে তাঁরা অবাক। এক জন ছাত্রীকে এ ভাবে হত্যা করার পরে যে ভাবে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে এবং তাতে পুলিশ ও প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা দেখে শিউরে উঠেছেন পাহাড়ি ওই মানুষগুলি। মঞ্জুর কথায়, “মানুষ এত বড় শয়তানও হতে পারে।”
প্রায় আধ ঘণ্টা আর জি কর নিয়ে আলোচনা শেষে ফেরার পথ ধরার পালা। প্রাতরাশের দাম মিটিয়ে, মঞ্জুদেবীকে নমস্তে বলে হাতের লাঠিটা তুলে নিতেই তিনি বলেন, “আবার আসবেন। আর যদি পারেন, ওই চিকিৎসকের মা-বাবাকে একটু জানিয়ে দেবেন— ইনসাফকি ইস লড়হাইমে উত্তরাখণ্ড কী ইয়ে মঞ্জু ভি উনকা সাথহি হ্যায়!”