• অমিল যথাযথ ট্রিটমেন্ট, রেফার রোগ জারি
    এই সময় | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • পেশায় দিনমজুর সফিকুল গত ১ সেপ্টেম্বর অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে হাবড়ার সোনাকেনিয়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। পরদিন ভোরে সেখান থেকে মোটরবাইক চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিনি ইটের পাঁজায় ধাক্কা দেন। গুরুতর জখম অবস্থায় সফিকুলকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বারাসত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় পর দিন তাঁকে রেফার করা হয় কলকাতায়৷ বাড়ির লোকজনের অভিযোগ, সফিকুলকে ভর্তি করাতে তাঁরা ৮ ঘণ্টা ধরে কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঘুরেছেন, কিন্তু কোথাও ঠাঁই মেলেনি। শেষে বারাসতেরই একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। তবে সফিকুলকে বাঁচানো যায়নি।একই ভাবে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে বিনা চিকিৎসায় হুগলির কোন্ননগরের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

    দু’টি ঘটনাতেই মৃতের পরিবার জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিবালও দাবি করেছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির কারণে রাজ্যে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকদের একাংশ পাল্টা প্রশ্ন তুলছেন, জেলায় জেলায় মাল্টি বা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি হওয়ার পরেও মুমূর্ষু রোগীকে কেন জেলা থেকে কলকাতায় ছুটে আসতে হচ্ছে?

    স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতির জেরে কলকাতার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে আউটডোর পরিষেবা ব্যাহত হলেও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ নতুন নয়। সে জন্য বহু পুরোনো সেই ‘রেফার রোগ’-কেই তাঁরা দায়ী করছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা, আরজি কর, এসএসকেএম কিংবা এনআরএসের মতো প্রথম সারির হাসপাতালগুলোয় রোগীর চাপ এতটাই বেশি থাকে যে, বহু মরণাপন্ন রোগীকেও ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অথচ, জেলা এবং মহকুমা হাসপাতালগুলোয় প্রচুর সংখ্যক বেড খালি পড়ে থাকছে।

    স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রের খবর, গত বছর অক্টোবরে প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল সতীশকুমার গর্গ একটি রিপোর্ট রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমকে দিয়েছিলেন। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের ১৫টি জেলা হাসপাতালে মোট বেডের সংখ্যা ১০,৫৪৫টি হলেও ২১৯৬টি বেড সারা বছর খালিই পড়ে থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল, সিউড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, দার্জিলিং সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, বালুরঘাট সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতাল, বসিরহাট সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, ইমামবাড়া সদর হাসপাতাল, নন্দীগ্রাম জেলা হাসপাতাল, বারাসত জেলা হাসপাতাল, কালিম্পং জেলা হাসপাতাল, তমলুক জেলা হাসপাতাল এবং আসানসোল জেলা হাসপাতাল।

    জেলা হাসপাতালগুলোয় বেড খালি থাকছে, তা হলে রোগীরা কেন কলকাতায় ছুটে আসছেন? তমলুক জেলা হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘আমাদের এখানে বহু অভিজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানোর জন্যে যে ধরনের পরিকাঠামো থাকা দরকার, সেটা এখানে নেই। তাই রেফার করতে আমরা বাধ্য হই।’

    গ্রামের গরিব মানুষ অসুস্থ হলে প্রথমে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা কোনও গ্রামীণ হাসপাতালে (কমিউনিটি হেল্‌থ সেন্টার) ছোটেন। কিন্তু সে রকম অধিকাংশ জায়গাতেই না-আছেন পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার, না-আছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সরঞ্জাম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্পেশালিস্ট মেডিক্যাল অফিসার (স্পেশালিস্ট) পদে মোট অনুমোদিত পদ ২৩৬০টি। বাস্তবে রয়েছেন ১৭৩২ জন। জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার (জিডিএমও) পদে ১৮৭১ জনের থাকার কথা, কিন্তু রয়েছেন ৫৪৮ জন।

    মহকুমা হাসপাতালগুলোর মোট ৬৭২ জিডিএমও পদে রয়েছেন ৩০০ জন। জেলা হাসপাতালগুলোয় ৩৯৪টি জিডিএমও পদে আছেন মাত্র ১৪৫ জন। কমিউনিটি হেল্‌থ সেন্টারগুলোয় যেখানে ৬১ জন জেনারেল সার্জেন থাকার কথা, সেখানে রয়েছেন মাত্র ৭ জন। গায়নেকোলজিস্ট পদ ৩৯০টি থাকলেও রয়েছেন মাত্র ৬৩ জন। পেডিয়াট্রিশিয়ান থাকার কথা ৩৬০ জন, আছেন মাত্র ২১ জন। অ্যানেসথেটিস্ট পদ ৩৬৪টি, আছেন মাত্র ২৫ জন।

    কলকাতার একটি নামকরা মেডিক্যাল কলেজের এক শীর্ষকর্তার আক্ষেপ, ‘যতদিন না জেলা হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা পরিষেবা উন্নত হবে, ততদিন রেফার রোগ সারবে না এবং বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনাও বন্ধ হবে না।’
  • Link to this news (এই সময়)