উজ্জ্বল পাল, বিষ্ণুপুর: বিষ্ণুপুরের শেষ স্বাধীন মল্লরাজা চৈতন্য সিংহের দেওয়ান ছিলেন চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়। আনুমানিক ২৩২ বছর আগে তিনি জয়পুরের ময়নাপুরে জমিদারবাড়িতে পুজোর প্রচলন করেছিলেন। সেই সময় মল্লরাজাদের পুজোর রীতি মেনে ১৫দিন ধরে পুজো চলত। তবে এখন রাজত্ব নেই। নেই জমিদারি। আগেকার সেই জৌলুস না থাকলেও আজও নিষ্ঠাভরে পুজোর আয়োজন করেন ময়নাপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান সদস্যরা। পুজোর ক’টাদিন আনন্দে তাঁরা মেতে ওঠেন।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ময়নাপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষের বাস ছিল হুগলি জেলায়। নিধিকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের তৎকালীন মল্লরাজাদের দেওয়ান শরোত্তর রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তীতে তাঁর মেয়ের সঙ্গে নিধিকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে দেন। তাঁকে জয়পুরের ময়নাপুরে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। পরবর্তীকালে বিষ্ণুপুরের শেষ মল্লরাজা চৈতন্য সিংহ নিধিকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের জৈষ্ঠ্য পুত্র চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়ের দক্ষতা দেখে তাঁকে দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন। প্রচুর জমি তাঁর হাতে তুলে দেন। পাকা বাড়িও নির্মাণ করেন। জমিদারি মহল তৈরি করা হয়। চণ্ডীচরণবাবু বিয়ের দীর্ঘদিন পর পুত্রসন্তান লাভ করেন। সেই আনন্দে ১৭৯১খ্রিস্টাব্দে তিনি কাছারির কাছেই মাটির ঘর তৈরি করে দুর্গাপুজো করেন। পরবর্তীকালে চণ্ডীমণ্ডপ তৈরি হয়। সেই চণ্ডীমণ্ডপ আজও অক্ষত রয়েছে। পুরনো বাড়িও ভেঙে চুরে গিয়েছে।
আগে জিতাষ্টমীর দিন থেকে পুজো শুরু হতো। পরবর্তীকালে পরিচালনার অভাবে তা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। বর্তমানে অন্যান্য পুজোর মতোই পঞ্চমী থেকে পুজো শুরু হয়। মুখোপাধ্যায় পরিবার বর্তমানে বিভক্ত হয়েছে। একাধিক সদস্য দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তবে পুজোর ক’টা দিন প্রায় সকলেই গ্রামে আসেন। আগে পুজোয় ছাগল বলি হতো। কয়েকবছর আগে তা বন্ধ করা হয়। এখন ছাঁচি কুমড়ো ও আখ বলি হয়। মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো দেখতে ময়নাপুরের বাসিন্দারা ছাড়াও আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে দর্শনার্থীরা আসেন।
জমিদার বংশের বর্তমান সদস্য শিবানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেন, আগেকার জৌলুস না থাকলেও এখনও আচার ও রীতি অনেকটাই বজায় রাখা হয়েছে। আমাদের পরিবারের খুদে সদস্যরা ছাগবলির রক্ত দেখে ভয় পেত। তাই পরবর্তীকালে তা বন্ধ করা হয়েছে।
পরিবারের আত্মীয় দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এক চালার উপর সাবেকিয়ানা বজায় রেখে প্রতিমা তৈরি করা হয়। দেবীর সঙ্গেই থাকে জয়া-বিজয়া। চণ্ডীচরণবাবুর পুত্র কালীপ্রসাদবাবু কর্মসূত্রে সিউড়িতে থাকতেন। তিনি মহাপুজোর জন্য যে পুঁথি নিজে হাতে লিখে গিয়েছেন, সেই অনুযায়ী আজও পুজো হয়।
পরিবারের কন্যা সুতপা মুখোপাধ্যায় সেন বলেন, ষষ্ঠীতে দেবীর বোধনের পর সপ্তমীতে হাকন্দপুষ্করিণীতে নবপত্রিকা স্নান করানো হয়। ওইদিন যে হোম শুরু হয়, তা নবমীতে পূর্ণাহুতির মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। এছাড়াও অক্ষয় প্রদীপ জ্বালানো হয়। সন্ধিপুজোয় ১০৮টি প্রদীপ জ্বালানো হয়। একসময় চণ্ডীমণ্ডপ সংলগ্ন আটচালায় যা ‘বাবুদের পাঠশালা’ নামে পরিচিত ছিল, বর্তমানে সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।