সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: হাতে হাতে স্মার্টফোন, আর ইউটিউব। হাতের মুঠোতেই দুনিয়া। তবুও ফি বছর মহালয়ার আগে ঘরের কোণে পড়ে থাকা ওই পুরনো যন্ত্রটার ডাক পড়ে। ঠিকই ধরেছেন। রেডিও। দেবীপক্ষের ভোরে কিংবদন্তি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতেই ঘরের রেডিওটার ঝাড়পোছ শুরু হয়। সেটিকে মেরামতের জন্য টিভি, রেডিও সারানোর দোকানে কার্যত লাইন পড়ে যায় পুরুলিয়ার গ্রামে। তাই তো আজকের হরেক টিভি চ্যানেল ও ওয়েব সিরিজের দাপাদাপির যুগে মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্তোত্রপাঠ শুনে বাঙালি বলে ওঠে ‘ওল্ড ইড গোল্ড’।
এখনও পুরুলিয়া জেলার আড়শার গ্রামে প্রবীণ মানুষজন মহালয়ার(Mahalaya 2024) ভোরে রেডিওর নব ঘোরান। সেই কারণেই সোমবার বিকেল থেকে ওই ব্লক সদরের টিভি, রেডিও সারানোর দোকানে রেডিও নিয়ে অনেকেই হাজির হন।
বদলেছে সময়। এখন সকলের বাড়িতেই টিভি। হাতে-হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন। এক ক্লিকেই কার্যত হাতের মুঠোয় দুনিয়া। তাই বহুদিন আগেই গুরুত্ব হারিয়েছে রেডিও। কাজ হারিয়েছেন রেডিও মেরামতের কাজে যুক্ত মেকানিকরাও। স্রেফ হাতেগোনা কয়েক জন এখনও একাজে যুক্ত। কিন্তু পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের সূচনায় মহালয়ার প্রাক্কালে অন্য ছবি ধরা পড়ল আড়শা ব্লকের একাধিক গ্রামে। ওই ব্লকের কুদাগাড়া গ্রামে বহু দিনের পুরনো দোকান মন্টু কুমারের। মন্টুবাবুর কথায়, ‘‘একটা সময় মহালয়ার আগে রাত-দিন কাজ করতে হয়েছে। এখন কাজ অনেক কমে গিয়েছে। নিয়মিত রেডিও শোনার লোক নেই বললেই চলে। তবে ব্যতিক্রম কি আর নেই? আমাদের গ্রামে আজও কিছু প্রবীণ মানুষ মহালয়ার আগে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ শোনেন। আর তাঁদের জন্যই বেশ কিছু পুরাতন রেডিও মেরামতের জন্য দোকানে এসেছে। কিন্তু সমস্যা হল রেডিওর যন্ত্রাংশ আর পাওয়া যাচ্ছে না। জানি না এই পেশার সঙ্গে আর কতদিন যুক্ত থাকতে পারব!’’ কিন্তু প্রবীণ মানুষের কাছে এখনও রেডিও একমাত্র বিনোদন। দেবীপক্ষের সূচনায় রেডিওতে মহালয়া শোনা না হলে তাঁদের পুজোই শুরু হয় না। মহালয়ার ভোরে রেডিওতেই শুনতে চান সেই কালজয়ী কণ্ঠ। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে রেডিও শুনে আসছেন আড়শা ব্লকের তুম্বা ঝালদা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত হাইস্কুল শিক্ষক মধুসূদন মাহাতো। তাঁর কথায়, ‘‘রেডিওতে মহালয়া শোনার আনন্দ-ই আলাদা। তাই তো এখনও রেডিওকে হাতছাড়া করিনি।’’
আড়শা ব্লকের কাঞ্চনপুর গ্রামের পঞ্চানন মাহালি। অভাবের সংসারে লেখাপড়া শেখার সুযোগ হয়নি। নিজের নাম স্বাক্ষরও করতে পারেন না। কিন্তু দেশ-বিদেশের খবর জানার আগ্রহ ভীষণ। নতুন রেডিও কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই খাবারের খরচের টাকা বাঁচিয়ে বছর চল্লিশ আগে কিনেছিলেন পুরনো রেডিও। সেটাকেই আজও হাতছাড়া করেননি তিনি। মহালয়ার আগে রেডিও যাতে কোনও সমস্যা না করে সেই জন্য আগেভাগেই দোকান নিয়ে গিয়েছিলেন পঞ্চাননবাবু। মহালয়ার আগে নিজের রেডিওটা ঠিকঠাক করে নিয়েছেন। মহালয়ার ভোরে সেখানেই যে বেজে উঠবে ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা…।’’