সেলিমকে দিল্লির শূন্যস্থানে নিয়ে গেলে বাংলায় কী হবে? কেন্দ্র এবং রাজ্যে সিপিএমের জল্পনায় ‘নেতৃত্বের সঙ্কট’!
আনন্দবাজার | ০২ অক্টোবর ২০২৪
নীচুতলার ভিত তো গিয়েইছিল, এ বার দেখা গেল, সিপিএম ভুগছে নেতৃত্বের সঙ্কটেও। নইলে মহম্মদ সেলিমকে নিয়ে দিল্লি এবং কলকাতায় দড়ি টানাটানি শুরু হত না।
সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুর পর সর্বভারতীয় সিপিএম কাউকে ‘ভারপ্রাপ্ত’ সাধারণ সম্পাদক না করে প্রকাশ কারাটকে ‘সমন্বয়ক’ করেছে। সিপিএম সূত্রের খবর, দল চায়, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে সীতার জায়গায় বসাতে। পার্টি কংগ্রেসের আগে সেলিমকে ওই বিষয়ে ভাবার সময় দিতে চায় সিপিএম। তাই আপাতত কারাটকে ‘সমন্বয়ক’ করার বিশেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে পলিটব্যুরো।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বঙ্গ সিপিএমে আলোচনা শুরু হয়েছে, সেলিম দিল্লি চলে গেলে রাজ্য সংগঠনের কী হবে? কে হাল ধরবেন? সেই আলোচনাতেই বারবার বেরিয়ে আসছে সিপিএমে ‘নেতৃত্বের সঙ্কটের’ প্রসঙ্গ। বাংলায় পর পর নির্বাচনে যে ভাবে সিপিএম যে ভাবে শূন্যের গেরো পেরোতে পারেনি, তা থেকে দলের অন্দরে একটা বিষয় স্পষ্ঠ যে, নীচুতলার ভিত হারিয়ে ফেলেছে সিপিএম। সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে বিস্তর দৌড়োদৌড়ি করছেন। তরুণ প্রজন্মকে তুলে আনার চেষ্টাও করছেন। কিন্তু তাতে ভোটের চিঁড়ে ভিজছে না।
২০২২ সালের মার্চে সেলিম রাজ্য সিপিএমের সম্পাদক হন। তার পর থেকেই তিনি তরুণ প্রজন্মের নেতানেত্রীদের গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছেন। সিপিএমের ‘রক্ষণশীলতা’র বেড়াজাল ভেঙে দিয়ে প্রকাশ্যেই সেলিম বলেছিলেন, মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় ‘দলের মুখ’। সেই সেলিম দিল্লি চলে গেলে তরুণ প্রজন্মের নেতানেত্রীরা সংগঠনে ‘খোলা মাঠ’ পাবেন কি না, তা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে সিপিএমে। ইয়েচুরির প্রয়াণ যে সর্বভারতীয় স্তরে সিপিএমে ‘শূন্যতা’ তৈরি করেছে তা একবাক্যেই মানছেন দলের নেতারা। ইয়েচুরির পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদক নির্ধারিত করার ক্ষেত্রেও দলে সেই নেতৃত্বের ‘সঙ্কট’ আলোচিত হচ্ছে।
সেলিমকে সময় দিতেই যে কারাটকে সমন্বয়ক করা হয়েছে, তা আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত হয় সোমবার। তার পর থেকেই সিপিএমে আলোচনা, সেলিম দিল্লি গেলে কে রাজ্যে হাল ধরবেন? বিভিন্ন সমীকরণ নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে দলে। গত রাজ্য সম্মেলনের আগে শ্রীদীপ ভট্টাচার্যকে রাজ্য সম্পাদক করার বিষয়ে অনেক নেতা আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। শ্রীদীপের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ছিলেন স্বয়ং বিমান বসু। কিন্তু রাজ্য সম্মেলনের শেষ ধাপে সেলিমই রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই সময়ে দিল্লির নেতারা যুক্তি দিয়েছিলেন, পলিটব্যুরোর সদস্যদের মধ্যে থেকেই রাজ্য সম্পাদক করতে হবে। শ্রীদীপ যে হেতু পলিটব্যুরোতে নেই, তাই তাঁকে ছিটকে যেতে হয়।
সেলিম ছাড়াও বাংলা থেকে পলিটব্যুরোতে রয়েছেন রামচন্দ্র ডোম এবং সূর্যকান্ত মিশ্র। এ বার পার্টি কংগ্রেস থেকে বয়সবিধির কারণে পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়ার কথা সূর্যকান্তের। তাঁর জায়গায় কে পলিটব্যুরোর সদস্য হবেন, সে দিকে নজর রয়েছে দলের অনেকেরই। সেলিম দিল্লির দায়িত্ব নিতে রাজি হলে তিনি পার্টি কংগ্রেস থেকে দায়িত্ব নেবেন। তার আগে ফেব্রুয়ারিতে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন হবে। সিপিএমের অনেকের বক্তব্য, সেলিম সর্বভারতীয় দায়িত্ব নিতে রাজি হলেও রাজ্য সম্মেলন থেকে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্বই নেবেন। পার্টি কংগ্রেসের পরে নতুন কাউকে রাজ্যের দায়িত্ব দেবেন। সে ক্ষেত্রে সূর্য মিশ্রের জায়গায় যিনি পলিটব্যুরোতে অন্তর্ভুক্ত হবেন, তাঁকে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব দিতে পারে আলিমুদ্দিন। তবে সবটাই নির্ভর করছে সেলিম রাজি হচ্ছেন কি না তার উপর।
সিপিএমের নেতারাও মানছেন, দলের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় মঙ্গলবার সারাদিন সেলিমের দিল্লি যাওয়ার সম্ভাবনার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। দলের অনেকেই বিষয়টির উল্লেখ করছেন। গত শনিবার নয়াদিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে ইয়েচুরির স্মরণসভা ৪০ মিনিট হয়ে যাওয়ার পরে মঞ্চে উঠেছিলেন সেলিম। তখন জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা বক্তৃতা করছিলেন। মঞ্চের উপরে একেবারে সামনের সারিতে সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, স্মরণসভার সভাপতি তথা সিপিএমের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট এবং বৃন্দা কারাট। ওই সারিতেই বসেছিলেন সেলিম। পলিটব্যুরোর বাকি সদস্যেরা বসেছিলেন পিছনের সারিতে। সেই বিষয়টিকেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন দলের অনেকে।
সূত্রের খবর, তালকাটোরা স্টেডিয়ামে স্মরণসভা শুরুর আগেই পৌঁছেছিলেন সেলিম। কিন্তু তিনি নীচে সাধারণের আসনে বসেছিলেন। তাঁকে বারংবার মঞ্চে যাওয়ার জন্য বার্তা পাঠাতে থাকেন বৃন্দা। শেষ পর্যন্ত তিনি মঞ্চে ওঠেন। সিপিএম নেতা অরুণ কুমার সেলিমকে নিয়ে গিয়ে প্রথম সারির ধারের একটি আসনে বসান। তার পর সেখান থেকেও সরিয়ে সেলিমকে আরও মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে আরএসপির সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য এবং জেএমএম সাংসদ মহুয়া মাঝির মাঝের আসনে বসানো হয়। যে ঘটনাকে ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ বলছেন সেলিম-ঘনিষ্ঠেরা।
বাংলায় ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পরে সিপিএম সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়েছে। ভোট ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে ১৩ বছর আগেও রাজ্যের শাসকদল। বাংলার বিধানসভায় আসন সংখ্যায় শূন্যে পরিণত হয়েছে বামেরা। লোকসভাতেও পর পর দু’টি ভোটে একটি আসনও জিততে পারেনি তারা। সেই ‘সাংগঠনিক সঙ্কট’ নেতৃত্বের স্তরেও প্রতিফলিত হচ্ছে। সেলিমের দিল্লি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতেই দলের একটা বড় অংশে হা-হুতাশ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, দিল্লিতে সঙ্কট সামাল দিলেও রাজ্যের নেতৃত্বের সঙ্কট সামাল দেবে কে? কী ভাবে?