এই সময়: আরজি কর ইস্যুতে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের বারবার কাজে ফেরার জন্য অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা হাইকোর্টের পরে সুপ্রিম কোর্টও আরজি কর মামলার চারটি শুনানিতেই কাজে ফেরার বার্তা দিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারদের। সোমবারও একই কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। তারপরেও জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে না-ফেরায় প্রবল অসুবিধার মধ্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা চালিয়ে যেতে হচ্ছে বলে জানাল রাজ্য সরকার।রাজ্য প্রশাসনের তরফে যুক্তি, শীর্ষ আদালতের নির্দেশ মেনে তারা হাসপাতালের সার্বিক সুরক্ষা ও পরিকাঠামো নিশ্চিত করতে সব রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। সরকারের আশা, এই আন্তরিক প্রয়াসকে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা।
কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য?
সু্প্রিম কোর্টে রাজ্য জানিয়েছে, গোটা রাজ্যে ২৮টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পরিকল্পনায় থাকা অতিরিক্ত ৮৯৩টি ডিউটি রুমের ৪৯% কাজ হয়ে গিয়েছে। ৭২৪টি অতিরিক্ত ওয়াশরুম তৈরির কাজও ৪০% এগিয়েছে। ৪৩৪৮টি নতুন আলোর বন্দোবস্তের মধ্যে ৩৩% কাজ হয়ে গিয়েছে। ৬১৭৮টি সিসিটিভি ক্যামেরার মধ্যে ২৬% ইতিমধ্যেই বসানো হয়ে গিয়েছে।
বাকি সব ক’টি কাজই আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টে জানায় রাজ্য। যদিও সেই সময়সীমা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে করার নির্দেশ দেয় সিজেআই ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ। রাজ্য সেই নির্দেশও মেনে নিয়েছে। শীর্ষ আদালতে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় রাজ্যের আশা, আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের আস্থা অর্জন করা যাবে এবং অচিরেই প্রায় ১১ হাজার জুনিয়র ডাক্তার কাজে ফিরবেন পুরোমাত্রায়।
রাজ্যের বক্তব্য, শীর্ষ আদালত আন্দোলনে হস্তক্ষেপ না করেও এর আগে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। গত ২২ অগস্ট প্রথম শুনানির দিনেই সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছিল, জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি তুলে নিলে সরকার কোনও বিরূপ পদক্ষেপ করতে পারবে না তাঁদের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য পরিষেবাকে দ্রুত স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে সরকার কোনও আইনানুগ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করেওনি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। বরং জুনিয়র ডাক্তারদের অধিকাংশ দাবিও ভালো ভাবে মেনে নিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
সরকারি হাসপাতালের আউটডোর, ইন্ডোর ও ইমার্জেন্সি ধুঁকতেই থাকে দুনিয়র ডাকরদের অভাবে। কর্মবিরতির ১৬ দিন পরে স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষীণ হয়ে কার্যত বিপর্যয় ঘনিয়ে আসায় গত ৭ সেপ্টেম্বর জুনিয়র ডাক্তারদের হাতজোড় করে কাজে ফেরার কাতর আবেদন জানায় রাজ্য সরকার। কিন্তু এতেও কোনও লাভ হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের সিনিয়র স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল সঞ্জয় বসু বলেন, ‘জুনিয়র ডাক্তাররাও কাজে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও তাঁরা ওপিডি ও আইপিডি সার্ভিস বয়কট করছেন। এটা শুধু শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অমান্য করা নয়, এতে রাজ্যে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ গুরুতর সমস্যায় পড়ছেন। রাজ্য সরকারের এক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপে কোনও বাধা নেই। কিন্তু তারা তা করেনি।’
রাজ্যের যুক্তি, ৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের দ্বিতীয় শুনানিতে আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, পরের দিন, অর্থাৎ ১০ তারিখ বিকেল ৫টার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে যোগ দিলে রাজ্য সরকার শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবে না। আদালত সাফ বলেছিল, জনস্বার্থেই চিকিৎসকদের কর্মবিরতি তুলে পরিষেবা দেওয়া উচিত। অন্যথায় সরকার কোনও ব্যবস্থা নিলে কোর্টের কিছু বলার থাকবে না।
যদিও শীর্ষ আদালতের বেঁধে দেওয়া সেই সময়সীমা আন্দোলনকারীরা লঙ্ঘন করার পরেও রাজ্য সরকার নরম মনোভাবই দেখিয়ে এসেছে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি। কারণ, সরকার চায়নি, দু’পক্ষের এই প্রশাসনিক টানাপড়েনের জেরে রোগীকুল কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তাই প্রথম থেকেই রাজ্য চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের আস্থা অর্জনে এবং পরিকাঠামো ও নিরাপত্তা উন্নয়নে সচেষ্ট থেকেছে।
এরই মধ্যে রাজ্য সরকার গত ১৬ সেপ্টেম্বর হলফনামা পেশ করে সু্প্রিম কোর্টকে জানায়, জুনিয়র ডাক্তারদের এই টানা কর্মবিরতির জেরে রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুলে ধরা হয়, জুলাইয়ের ৮২% বেড অকুপ্যান্সি রেট অগস্টে ৫৪% হয়ে গিয়েছে, শুধু অগস্টেই ৬০% সার্জারি ও ৫৫% ক্যাথ ল্যাব প্রসিডিয়োর কমে যায় এবং আউটডোরে রোগীর সংখ্যা কমে ৪৫% হয়ে যায়।
রাজ্যের জানিয়েছে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর তৃতীয় শুনানির দিন রাজ্যের বর্ষীয়ান আইনজীবী প্রায় জোড়হাত করে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার আবেদন জানান। এর পরেও তাঁরা কাজে ফেরেননি। কিন্তু রাজ্য তার আশ্বাসমতো জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তায় ডিউটি রুম ও ওয়াশরুম নির্মাণ, আলোর ব্যবস্থা, সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর মতো একের পর এক গুচ্ছ পদক্ষেপ করে চলেছে।