এই সময়, এগরা: পরীক্ষা শেষ। তবু পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার ঝাটুলাল হাইস্কুলের প্রশ্ন-বিতর্ক থামতেই চাইছে না। ক্লাস ইলেভেনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষায় আরজি করের নির্যাতিতার বয়ানে প্রশ্ন করা নিয়ে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দাবি, প্রশ্নকর্তা শিক্ষক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। অথচ সেই শিক্ষক বাসুদেব নন্দী মঙ্গলবার ‘এই সময়’-কে জানান, তাঁর মতে, এই প্রশ্নটিই পরীক্ষার সেরা প্রশ্ন।কী ছিল সেই প্রশ্ন?
‘শিক্ষা আমার মৌলিক অধিকার। আমি অভয়া, অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার। আমাকে মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে পাশবিক অত্যাচার করে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে খুন করা হয়েছে। আমার সঠিক বিচার হোক।’ নির্যাতিতার এই বয়ানের পরেই প্রশ্ন ছিল, ‘উপরে বর্ণিত শিক্ষার অধিকারটি সংবিধানের কোন ধারায় রয়েছে?’
সোমবার এই প্রশ্নের কথা জানাজানি হওয়ার পরে বিতর্ক দেখা দেয়। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু রিপোর্ট চেয়ে পাঠাবেন বলে জানান। অভিযোগ ওঠে, যে ঘটনা নিয়ে সিবিআই তদন্ত চলছে, সেখানে অভয়াকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে খুন’ করা হয়েছে বলে কী করে বলে দেওয়া যায়? কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী নীলাদ্রি শেখর ঘোষের মতে, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এই ধরণের প্রশ্নপত্র তৈরি বৈধ নয়।
এর জন্য প্রয়োজনে বিচারক ‘ক্রিমিনাল রুল অফ কনটেম্পট’ জারি করতে পারেন। প্রশ্নের মূল কথা উচ্চশিক্ষার অধিকার সংবিধান-এর কোন ধারায় স্বীকৃত। এই প্রশ্নের সঙ্গে অভয়ার ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
এখনও পর্যন্ত ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ ও জেলা শিক্ষা দপ্তর। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, পুজোর ছুটির পরে স্কুল পরিচালন কমিটি ও টিচার কাউন্সিলের বৈঠকে এই প্রশ্ন-বিতর্ক নিয়ে আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মঙ্গলবার স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেবাশিস জানা স্কুলে এসে এই বিষয়ে বাসুদেবের কাছ থেকে জানতে চান। প্রধান শিক্ষক পরে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক প্রশ্ন-বিতর্কে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আবেগতাড়িত হয়ে এই কাজ করে ফেলেছেন বলে স্বীকার করেছেন।’ বাসুদেব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্কুলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে তিনিই একমাত্র শিক্ষক।
প্রায় ২১ বছরের বেশি শিক্ষকতা করছেন। এর আগে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, কোনও বিচারাধীন বিষয়ের ওপর প্রশ্ন না করাই উচিত ছিল। আগামী স্কুল পরিচালন কমিটির বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগামিদিনে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, সে দিকে নজর রাখা হবে।’ এ দিন বিকেল পর্যন্ত এই বিষয়ে শিক্ষা দপ্তরের কোনও মেল বা বার্তা তাঁর কাছে আসেনি বলেও জানান তিনি।
তবে প্রধান শিক্ষকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেও নির্দিষ্ট প্রশ্নটির বয়ানে বিতর্কের কিছু দেখছেন না বলে জানিয়েছেন বাসুদেব। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমন একটা বিষয়, যেখানে সাম্প্রতিক কোনও বিষয় ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরতে হয়। এ বারের পরীক্ষায় শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটি সেরা প্রশ্ন বলে আমার মনে হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করতেই এমন প্রশ্ন রেখেছিলাম। কোনও বিতর্ক তৈরির জন্যে প্রশ্ন করিনি।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্রে বিচারাধীন বিষয় রাখা ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন এগরার তৃণমূল বিধায়ক তথা শিক্ষক তরুণ মাইতি। তাঁর কথায়, ‘চক্রান্ত করেই প্রশ্নপত্রে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।’
এগরা শহর তৃণমূল সভাপতি উদয় পাল অভিযোগ করে বলেন, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। সে কারণে সচেতন ভাবেই তিনি এমন প্রশ্ন করেছেন বলে আমার মনে হয়। আমরা আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের সঙ্গে দোষীর কঠিন শাস্তির দাবি জানিয়েছি। তা ছাড়া সিবিআই ঘটনার তদন্ত করছে। সুপ্রিম কোর্টে বিচার চলছে। বিতর্ক সৃষ্টির জন্যে এমন প্রশ্ন করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।’
বিজেপির এগরার নগর মণ্ডলের সভাপতি চন্দন মাইতি বলেন, ‘এমন প্রশ্ন করে তিনি কোনও ভুল করেননি। নির্যাতিতা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলেই শিক্ষার অধিকার প্রশ্নে শিক্ষক ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।’ জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (ডিআই মাধ্যমিক)শুভাশিস মৈত্রকে বার বার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।