অর্ণব দাস, বারাসত: মৌয়ের কচুরি। দোকানের সামনে ঝুলছে সাইন বোর্ড। ভিতরে ছোট পরিসর। এক ধারে জ্বলছে কাঠের উনুন। আঁচ এসে লাগছে চোখে-মুখে। তৈলাক্ত মুখে ক্লান্তি ছাপ স্পষ্ট। একা হাতে দশদিক সামলে যাচ্ছেন তরুণী। ক্লান্তি থাকলেও অবস্তি নেই। সামলে যাচ্ছেন একের পর গ্রাহক। ‘দশভুজা’ হয়ে উঠেছেন তিনি।
পুজোর বাকি মাত্র কটা দিন। দেবী ‘দশপ্রহরণধারিণী’র আরধনায় মাতবে সকলে। পাড়ার মণ্ডপে,মণ্ডপে প্রস্তুতি তুঙ্গে। তবে পরিবারের কাছে জীবন্ত ‘দশভুজা’ হাবড়ার তরুণী মৌমিতা ওঝা ওরফে মৌ। মারণ রোগ ক্যানসারে তাঁর বাবা মার যাওয়ার পর নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন সংসারের দায়িত্ব। পাশাপাশি স্নাতকোত্তরের পড়াশোনাও চালাচ্ছেন তিনি। ইতিহাসে এমএ করছেন তরুণী। অসময়ে বাবার ফেলা যাওয়া কচুরির দোকান চালিয়ে উপার্যনের পথ খুঁজে নিয়েছেন মৌমিতা।
হাবড়া রেল স্টেশনের ১ নম্বর প্লাটফর্মের ওভারব্রিজের নিচে কচুরি পারিবারিক ব্যবসা ছিল মৌদের। মৌমিতার বাবা বিষ্ণু ওঝা ও জেঠু বছর চল্লিশেক ধরে কচুরি বিক্রি করতেন। লকডাউনের সময় সেই ব্যবসা আলাদা হয়। তখন মৌ ইতিহাস অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তার পরেই বিষ্ণুবাবুর লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেই সময় বাবাকে সহযোগিতা দোকানে আসা শুরু করেন তিনি। তাঁর কথায়, “অসুস্থ বাবাকে সাহায্য করতে দোকানে আসা শুরু করি। ভেবেছিলাম বাবা একটু সুস্থ হলে পড়াশোনায় মন দেব। বাবা অসুস্থ থাকাকালীন সঙ্গেই থাকতাম বলে খুব কাছ থেকে দেখেছি কাশি হলে মুখে রক্ত উঠে আসত। সন্তান হিসাবে এমন পরিস্থিতিতে কী করে বাড়িতে বসে থাকতাম।” যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। মরণব্যাধি ক্যানসারে ২০২১ সালের জুলাই মাসে মারা যান বিষ্ণুবাবু।
সংসারে অনটন দেখা দেয়। তাই সংসারের হাল ধরতে ব্যবসাতেই মনোনিবেশ করেন কলেজ ছাত্রী। তবে পড়াশোনা ছেড়ে দেননি। যুবতী জানান, ‘বাবা হঠাৎ চলে যাওয়ায় মা আর আমার বাঁচার জন্য দোকান চালানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। তাই নিজেই ব্যবসার হাল ধরি।’ তবে, ‘বটবৃক্ষের’ চলে যাওয়ায় সূর্যের প্রখর তেজ প্রতি পদে অনুভব করেন। একসময় বেচাকেনাও প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু জীবনযুদ্ধে হার মানেননি তিনি। দাঁতে, দাঁত কামড়ে লড়াই করেছেন। তার ফলও মেলে। স্টেশনের পুরনো দোকানের পাশাপাশি যশোর রোড সংলগ্ন হাবড়ায় দাসপাড়ায় আরেকটি দোকান হয়েছে। দুটি দোকান মিলিয়ে আটজন কাজ করেন মৌয়ের অধীনে। নিজের পরিবারের পাশাপাশি আরও আটজনের পরিবারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই।
পাশাপাশি, এই বর্ষেই তাঁর ইতিহাসে এমের ফাইলান। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও ব্যবসাকেই আগামী দিনের পেশা করবেন বলেই জানিয়েছেন মৌ। তাঁর মতে, এখন দোকানে সাতজন আছে কাজে সহযোগিতা করার জন্য। নতুন দোকানে আরও একজন আছে। সকলেরই পরিবার চলছে দোকানের উপর নির্ভর করে। তাই আগামী দিনে এই ব্যবসাকেই বড় করার চেষ্টা করব। আমি মনে করি যদি মন থেকে কারোর কিছু করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সকলের পক্ষেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। কোন কাজই ছোট নয়। পাশাপাশি এই বর্ষেই এমএরের ফাইলান পরীক্ষা দেবেন। তাহলে কী উচ্চশিক্ষার পর ব্যবসা ছেড়ে দেবেন। মৌ জানিয়েছেন, ‘এখন দোকানে সাতজন আছে কাজে সহযোগিতা করার জন্য। নতুন দোকানে আরও একজন আছে। আমাদের সকলেরই পরিবার চলছে এই দোকানের উপর নির্ভর করে। তাই আগামী দিনে এই ব্যবসাকেই বড় করার চেষ্টা করব। আমি মনে করি যদি মন থেকে কারোর কিছু করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সকলের পক্ষেই প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। কোনও কাজই ছোট নয়।’ বেজে উঠেছে দেবীর আগমনী সুর। শরতের পড়ন্ত গোলাপি রোদে নীল-সাদা আকাশে মেঘের কোণে যেন দেখতে পারেন বাবা আকৃতি। আড়ালে জল মুছে ফের কাজে মন দেন হাবড়ার ‘দশভূজা’।