জন্মদিনে বাড়ি, অফিস বা দলীয় কার্যালয়, কোথাও নেই কাউন্সিলর অনিতা, জনরোষের ভয় না মনস্তাপ
আনন্দবাজার | ০৩ অক্টোবর ২০২৪
বৃহস্পতিবার জন্মদিন ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অনিতা কর মজুমদারের। যেমন বৃহস্পতিবারেই জন্মদিন টালিগঞ্জের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের। ছাত্রের মৃত্যু ঘিরে যে বাঁশদ্রোণী বুধবার থেকে উত্তাল, তা অরূপের বিধানসভা কেন্দ্রেই অন্তর্গত। কিন্তু তাঁকে বাঁশদ্রোণীর কোথাও দেখা যায়নি। যেমন দেখা যায়নি অনিতাকেও। বাড়ি, পার্টি অফিস বা ওয়ার্ড অফিসে দেখা মেলেনি তাঁর। তিনি কোথায়, কেউই বলতে পারছেন না। অথবা বলতে চাইছেন না। কলকাতা পুরসভার এক পদস্থ আধিকারিককের কথায়, ‘‘বুধবার কিছু ক্ষণ উনি থানায় ছিলেন। তার পরে কোথায় গিয়েছেন বলতে পারব না।’’ কেন বাঁশদ্রোণীর ঘটনাস্থলে যাননি অনিতা, সে প্রশ্নের জবাবে ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘ওখানে গিয়ে উনি গণরোষের মুখে পড়তে পারতেন। ওঁর যা করার, উনি সেটা করছেন। ওখানে গেলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হতে পারত।’’
বুধবার পে লোডারের ধাক্কায় নবম শ্রেণির পড়ুয়ার মৃত্যু ঘিরে এখনও ক্রুদ্ধ বাঁশদ্রোণী। ঘটনার পর থেকে বাসিন্দারা এলাকায় স্থানীয় কাউন্সিলর অনিতাকে দেখেননি। ঘটনার দিন কয়েক বার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ফোনে কথা বললেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কারও ফোনও ধরেননি অনিতা। রাইফেল ক্লাব রোডের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গেই থাকেন কাউন্সিলর। অন্যদিনের মতো অনুগামী বা কর্মী-সমর্থকদের ভিড় নেই সেখানে। বাড়ির ভেতরেই যে কাউন্সিলরের অফিসটি রয়েছে, তা-ও বুধবার থেকে বন্ধ বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্য রীতা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, ঘটনার পরেই বেরিয়ে আর বাড়িতে ফেরেননি পরিবারের ছোট বউ অনিতা। কোথায় আছেন, তা-ও জানা নেই তাঁদের। অনিতার জন্মদিনের প্রসঙ্গ তুলতেই ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলেন প্রৌঢ়া।
শহিদ বিনয় বোস রোডের একটি আবাসনের নীচে ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল পার্টি অফিস। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেখানেও তালা ঝুলছে। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের দাবি, বুধবার রাত ১১টা পর্যন্ত পার্টি অফিসে ছিলেন কাউন্সিলর। সেখান থেকেই দীনেশ নগর অটো স্ট্যান্ডে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে খোঁজ নিয়েছেন তিনি। দলীয় সূত্রের খবর, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে কাউন্সিলরকে ‘মুখ বন্ধ’ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনা কেন্দ্র করে অহেতুক কোনও বিতর্ক চাইছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। রাতে পার্টি অফিস থেকেই দলীয় নেতৃত্বকে ঘটনার বিষয়ে বিশদে জানান অনিতা। আপাতত দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছেন তিনি। তবে স্থানীয়েরা তাঁর এই ‘আত্মগোপনে’ সন্তুষ্ট নন। তাঁদের যুক্তি, এমন সময়ে নিহত কিশোরের বাড়ি গিয়ে তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে আসা উচিত ছিল কাউন্সিলরের। কারণ, তিনি এলাকার মানুষের প্রতিনিধি। কিন্তু ঘটনার পর নিজেকে সুরক্ষিত করতে প্রথমে থানায় গিয়ে ‘আশ্রয়’ নেন তিনি। পরে থানা থেকে বেরিয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছেন।
তৃণমূলের পার্টি অফিসের কাছেই ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুরসভার অফিস। সোম থেকে শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত সেখানে বসেন কাউন্সিলর অনিতা। কিন্তু বুধবারের পর বৃহস্পতিবারও ওয়ার্ড অফিসে বসেননি তিনি। ফোন করে প্রয়োজনীয় কাজের নির্দেশ দিয়েছেন। কাউন্সিলর অফিসের কর্মীরা বলেন, ‘‘আড়ালে থেকে দিদি কী কী কাজ করছেন, সেটা কেউ জানে না। কেউ খোঁজও রাখছেন না। আমরা দিদির জন্মদিন পালন করব বলে পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে দিদি সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছেন। নিহত কিশোরের পরিবারকে কী কী ভাবে সাহায্য করতে পারেন, তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছেন।’’
২০০০ সালে ১১২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের টিকিটে কাউন্সিলর হন অনিতা। মহিলা সংরক্ষণের কারণে ২০০৫ সালে তাঁকে ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁকে টিকিট দেয় তৃণমূল। সেখানেও জেতেন অনিতা। পর পর চার বার ওই ওয়ার্ড থেকে জয়ী হয়েছেন। অন্য সব নির্বাচনেও তাঁর ওয়ার্ড থেকে তৃণমূল প্রার্থীরা নিরাপদ ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় দলের অন্দরে কখনও অনিতাকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।
কিন্তু এই দুর্ঘটনা তাঁকে আচমকাই এলাকাবাসীর কাছে ‘ভিলেন’ বানিয়ে দিয়েছে। তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, সেই কারণেই পরিচিত লোকেদের কিছুটা ‘অচেনা’ ঠেকছে কাউন্সিলরের। ‘মর্মাহত’ হয়ে পড়েছেন পাঁচ বারের কাউন্সিলর। তাই কার্যত স্বেচ্ছায় অন্তরালে চলে গিয়েছেন অনিতা। এমনই দাবি করলেন তাঁর ওয়ার্ড অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত অলোক কুমার চক্রবর্তী। এই প্রাক্তন ব্যাঙ্ক আধিকারিকের দাবি, ‘‘যে বা যাঁরা অনিতাকে অমানবিক বলেছেন বা থানা ঘেরাও করছেন, তাঁরা তো ওই ছাত্রের বাড়ি গিয়ে তার মরদেহে মাল্যদান করার সৌজন্য দেখাননি! ওই এলাকার খারাপ রাস্তা নিয়ে আমাদের কাউন্সিলর কেইআইপি-র বিরুদ্ধে কত বার ক্ষোভ প্রকাশ করে অভিযোগ জানিয়েছেন, তা-ও তো কারও জানা নেই।’’ অলোক আরও বলেন, ‘‘গত ন’বছর ধরে কাউন্সিলরের উদ্যোগে আমরা ওয়ার্ডের সেরা পুজোগুলিকে পুরস্কার দেওয়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু বুধবারের ঘটনার পরেই অনিতা আমাকে নির্দেশ দেন, ওই প্রতিযোগিতা আর করা যাবে না। আমরা কিছু বলার আগেই তিনি নিজে আমাদের বলেছেন, তাঁর জন্মদিন নিয়ে যেন ওয়ার্ডের কোথাও কোনও অনুষ্ঠান না করা হয়। আমি জানি, ছেলেটির পরিবারের জন্য অনিতা কী কী করছেন। কিন্তু আমি তা বলব না। ছেলেটির মৃত্যুর পরে যে মানসিক আঘাত কাউন্সিলর পেয়েছেন, তা কাটিয়ে এসে নিজেই সে কথা ঘোষণা করবেন।’’