‘হেসে হেসে করি বা নেচে, প্রতিবাদ করেছি’, আগমনী আড্ডায় সাফ কথা রাত দখলের প্রতিনিধিদের
আনন্দবাজার | ০৩ অক্টোবর ২০২৪
১৪ অগস্ট প্রথম বার মেয়েদের রাত দখল দেখেছিল শহর কলকাতা। সেটাই এক মাত্র রাত দখল নয়। রাতের পর রাত পথে থেকেছেন শহরের মেয়েরা। পথে নেমেছেন সাধারণ মানুষ। সেই প্রতিবাদের আঁচ গিয়ে পড়ছে শহরতলি থেকে রাজ্যের নানা প্রান্তে। দেবীপক্ষের প্রথম দিনে আনন্দবাজার অনলাইনের আগমনী আড্ডায় অতিথি হয়ে এলেন রাত দখলের মেয়েদের প্রতিনিধিরা। সুদীপ্তা চক্রবর্তী, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, বন্যা কর, তানিকা বসুদের কণ্ঠে উঠে এল সমান অধিকারের দাবি থেকে সমাজের অসুর নিধনের সাহসী কথাবার্তা। দৃপ্ত কণ্ঠে তাঁরা জানালেন, “রাত দখল চলবে হেসে হেসে, নেচে নেচে।”
তাঁদের দাবি, এ বার পুজো শুধু উৎসবের নয়, রাত দখলেরও। এই আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ মানুষ যেমন যুক্ত হয়েছেন, তেমনই যোগ দিয়েছেন চিত্র তারকারও। তিলোত্তমা কল্লোলিনী হয়েছে তাঁদের প্রতিবাদী কণ্ঠের দাপটে। পথে নেমে প্রতিবাদ করায় যেমন প্রশংসিত হয়েছেন তাঁরা, তেমনই কটাক্ষের শিকারও হয়েছেন। এঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন স্বস্তিকা ও সুদীপ্তারা। ধেয়ে আসা কটাক্ষ, সমালোচনা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নন স্বস্তিকা। আগমনী আড্ডায় তিনি সাফ বললেন, “‘ট্রোলড্’ এই শব্দটাই তো অভিধানে ছিল না। হালে এ সব শুনছি। যাঁরা এই কাজটা করেন, তাঁরা তো তাঁদের চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে এই বিশেষ গুণটির কথা লিখতে পারেন। তাঁরা থাকলেন বা থাকলেন না, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। আসলে ১৪ অগস্ট বা তার পর যতগুলো রাত দখলে যোদ্ধারা রাস্তায় নেমেছেন, সকলে যে স্লোগান দিতে এসেছিলেন, তেমনটা নয়। সকলে রাস্তায় নেমেছিলেন একে অপরের পাশে দাঁড়াতে, মনোবল বাড়ানোর জন্য।”
স্বস্তিকার সঙ্গে সহমত সুদীপ্তা। তবে তাঁর মনে হয় সাধারণ মানুষ অনেক দিন ধরেই অনেক কিছুর প্রতিবাদ করতে চাইছিলেন। কেবল একটা ডাকের প্রয়োজন ছিল। সুদীপ্তার দাবি, “সৈন্যরা তৈরিই ছিলেন, একজন সেনাপতির অভাব ছিল। তাই কে, কোথায় ডাক দিলেন, সেটার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল ডাক পাওয়াটা।”
যে আন্দোলন পিতৃতন্ত্রের ভিত্তিতে আঘাত হানছে সেই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে আন্দোলনের শরিক বন্যাকে শুনতে হয়েছিল তাঁর “শাড়ির তলায় কী আছে!” সমাজের অনেকে কাছে এখনও বন্যারা আলাদা তালিকাভুক্ত। বন্যার কথায়, “রাত দখলের ডাক যখন দেওয়া হয় তাঁদের একজন ছিলাম আমি। তখন আমাকে শুনতে হয়, ‘তোমার শাড়ির তলায় কী আছে, যে তুমি আন্দোলনে যাবে!’ প্রশ্ন তোলা হয় মেয়েরা আদৌ সুরক্ষিত তো আমার সঙ্গে। যদিও সেই রাতে অন্য নারীরাই প্রমাণ করে দিয়েছেন তাঁরা সত্যিই সুরক্ষিত আমার সঙ্গে।”
এই একই সমাজে ঠিক কত রকমের বৈচিত্র। যে সমাজ এক নারীর উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়ছে। তারাই আবার, যাঁরা বন্যার মতো মনে প্রাণে নারী, তাঁদের আলাদা পংক্তিতে বসাতে চান। বন্যা বলেন, “সে দিন প্রতিবাদী জমায়েতের আগে অনেকেই বলেছিলেন ‘এরাও যাবে?’ আমি এই ‘এরা’ হয়ে থাকতে চাই না।” ঠিক সেই সময় বন্যাকে সাহস দিয়ে সুদীপ্তা বললেন, “যাঁরা বলবে ‘এরাও থাকবে?’ তাদের তোমরা বলবে, ওখানে ‘ও’ নয় ‘ই’ হবে। ‘এরাই থাকবে’, সব আন্দোলনে।”
সব প্রতিবাদী আন্দোলনেই বন্যা ও তাঁর বন্ধুরা যোগ দেন। তা সে কামদুনি হোক বা আসিফার জন্য ন্যায়ের দাবি। এই জায়গাতেই উঠে আসে আরও এক ‘ট্রোল’ কাহিনি। বার বার প্রশ্ন উঠেছে তারকাদের নিয়ে, কেন তাঁরা এর আগে কখনও এ ভাবে পথে নামেননি, ভারতের নানা প্রান্তে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় কেন তাঁরা মুখ খোলেননি? এই প্রসঙ্গে অবশ্য সুদীপ্তা বলেন, “আসলে এত উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। আর তার পরও যদি বলেন, কেন প্রতিবাদ করিনি, তা হলে বলব, ও এতদিন বলিনি? এই নিন কান ধরলাম। এতদিন বলিনি, কিন্তু এখন বলছি, আপত্তি আছে?”
চলচ্চিত্র জগতে নবাগত তানিকা। অগ্রজা স্বস্তিকা, সুদীপ্তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তিনি। নারী সুরক্ষা ও সমানাধিকার চেয়ে পথে নেমেছেন তানিকাও। অভিনেত্রীর কথায়, “পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে আলাদা করে কিছু বলব না। তবে এই ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে মহিলাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সেটাই অবাক লাগছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বুঝলাম ভয়ের মতো সাহসও আসলে ছোঁয়াচে।”
এই আন্দোলনের প্রায় প্রতি মুহূর্তে সমালোচিত হয়ে যে ভাল দিকটা গ্রহণ করেছেন স্বস্তিকা, তা হল, অনেক মানুষের কাছাকাছি আসা, পরস্পরকে জানা আর সমস্বরে প্রতিবাদ করা। স্বস্তিকার কথায়, “এই আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষাটাকে নতুন করে গ্রহণ করলাম। আমাদের শব্দকোষটা গত কয়েক বছরে পরিপূর্ণ হয়েছে গিয়েছে ‘লাইক’, ‘উই নো’-র মতো শব্দে। এই আন্দোলনে থাকতে থাকতে এ সব শব্দ ব্যবহার অনেক কমেছে।” অন্য বছর মণ্ডপে বাঁশ পড়ার সময় থেকেই পুজোর দিন গুনতে থাকেন অভিনেত্রী। কিন্তু এ বার একটাও নতুন পোশাক কেনেননি তিনি, মন থেকেই চাননি।
রাত দখল প্রসঙ্গে অভিনেত্রীরা কটাক্ষ শুনেছেন, কে কোথায় হেসেছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী খেয়েছেন তা নিয়ে। সে সব চুলচেরা বিশ্লেষণকে অবশ্য পাত্তা দিতে নারাজ স্বস্তিকা। তাঁর সুরেই বন্যা বলে উঠলেন, “আমাদের ট্রোল করতে গিয়ে আমাদের প্রচার করছেন একদল মানুষ। আন্দোলনে আছি আমরা। হেসে হেসেই করি কিংবা নেচে নেচেই করি, আমরা আন্দোলন করছি।” সব শেষে সুদীপ্তার মিষ্টি মুখ করতে করতেই দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, “লোকে এটা দেখেও বলবে ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে, মিষ্টি খেতে খেতে প্রতিবাদ হচ্ছে! এরা সুবিধাবাদী, এরা নষ্ট মহিলা। আমি ট্রোলারদের লাইনটা ধরিয়ে দিলাম, আসুন দলে দলে কটাক্ষ করে যান। ’’