উৎসব না উৎশব — এই নিয়ে অনর্গল বিতর্কের মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে দেবীপক্ষ। ‘অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িনী’ শব্দদ্বয় শহরে ঘটে যাওয়া তরুণী চিকিৎসকের বীভৎস ধর্ষণ-খুনের পরে অন্য মাত্রা পেয়েছে। এই ভয়াবহ অপরাধে জডি়তদের শাস্তি ও মহিলাদের জন্য নিরাপদ সমাজ চেয়ে বারবার হয়েছে রাতদখল, ভোরদখল-সহ স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন। তবে রোজ রাস্তায় বেরনো যে কোনও বয়সি মহিলারা যে ধরনের ‘ব্যাড টাচ’-এর মুখে পড়েন, তার কী হবে?সেই প্রশ্নই যেন উস্কে দিল তিনটি বিখ্যাত পুজোয় কিছু অডিয়ো বার্তা। দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘ, হিন্দুস্তান পার্ক ও যোধপুর পার্কের মণ্ডপে পঞ্চমী থেকে বাজানো হবে এই অডিয়ো। শোনা যাবে ঊষা উত্থুপ ও ঋতাভরী চক্রবর্তীর কণ্ঠে।
কী শোনা যাবে?
যেমন, ‘নিজের কনুই নিজের কাছে রাখুন।’ এর অর্থ কোনও বয়সের মহিলেদের বোঝানোর প্রয়োজন নেই। ভিড় ট্রামে-বাসে-ট্রেনে, অটোর সামনের সিটে বসে থাকা মেয়েরা কনুইয়ের গুঁতো খাননি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দায়। আবার ‘কাছের লোক না হলে বেশি কাছে আসবেন না’ — রয়েছে এই বার্তাও।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পরতে পরতে বিপদ। অনেক সময়েই অল্পবয়সি মেয়েরা নানা টোপ গেলে। এর মাধ্যমে দু’টো বার্তা দেওয়া লক্ষ্য। প্রথমত, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা বিপদ ডেকে আনতে পারে ও দ্বিতীয়ত, অনলাইনেও বুদ্ধি করে নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে।
হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সেক্রেটারি সুতপা রায়চৌধুরী বললেন, ‘মহিলারা অনেক সময়ই নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। সে জন্যই এই বাতার্র ভাবনা। এভারেডি সংস্থার সহায়তায় আমরা এই ক্যাম্পেন করছি। ওরা একটা সাইরেন-টর্চও এনেছে। সঙ্গে এই অডিয়ো মেসেজ। সমাজকে সুরক্ষিত করতে এটা আমাদের একটা ছোট্ট প্রয়াস।’ অন্য পুজো কমিটিও সহমত।
সামাজিক নিরাপত্তা ও দৈননন্দিন জীবনে চলাফেরার পথে যে সব লোকেদের কারণে মহিলারা হেনস্থার মুখে পড়েন, তাদের যে নজর করা হয় তা এই সব বার্তা থেকে স্পষ্ট। বিষয়টা অবশ্য শুধু অডিয়ো-বার্তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। ওই প্যান্ডেলগুলোর এন্ট্রি রোডে সারি দিয়ে যে গেট করা হয়েছে, তাতে সর্বত্র আটকানো মেগাফোন। একটা সময়ে মেগাফোনে ঘোষকের দায়িত্ব থাকত পুরুষের হাতেই। এ বার সেখানে শোনা যাবে মহিলা কণ্ঠ। সেলেব্রিটিরা তো রয়েছেনই, প্যান্ডেল থেকে যে ঘোষণা করা হবে তাও করবেন মহিলারাই।
এভারেডি কর্তা অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘দুর্গাপুজো নারীশক্তির উদযাপন। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ যদি এই মেসেজগুলো শোনেন তার একটা ইমপ্যাক্ট তৈরি হবেই।’ তাঁরা যে সব পুজোর সঙ্গে টাই-আপ করেছেন, সেখানে তাঁদের থিম ‘এভারেডি সাইরেন — পুজোয় আওয়াজ তোলার পাওয়ার।’ তিনি জানালেন, তাঁরা পুজো প্যান্ডেলের ভলান্টিয়ারদের জন্য ‘সাইরেন স্কোয়াড টি-শার্ট’ বানিয়েছেন, যাতে ঠাকুর দেখতে এসে কেউ বিপদে পড়লে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যান সহায়তা দেওয়ার জন্য।
এমন অভিনব ক্যাম্পেনের কণ্ঠ হয়ে বেশ গর্বিত ঊষা। তাঁর কথায়, ‘দুর্গা পুজো মানে মহিলাদের ক্ষমতায়ন করার গুরুত্ব অনুভব করা। আমি মনে করি প্রতিটি মেয়ে মা দুর্গার মতোই শক্তির আধার, নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান।’ ঋতাভরী বলছেন, ‘পুজো স্পিরিটকে অর্থবহ করে তুলতে প্রয়োজন প্রতিটি মহিলা যাতে নিজেকে নিরাপদ ও এম্পাওয়ার্ড মনে করেন। আমরা যেমন দুর্গা-শক্তির উপাসক, তেমনই আমরা প্রতিজ্ঞা করি আমাদের আশেপাশের সব মহিলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।’
এভারেডি জানিয়েছে, এর সঙ্গে আর জি করের ঘটনা নেহাতই কাকতালীয়। কিন্তু তাও কোথায় যেন মিশে গিয়েছে সমাজের অর্ধেক আকাশকে সম্পূর্ণ আকাশে রূপান্তরের অঙ্গীকার।