মুম্বইয়ের জুহুতে বহু বছর ধরে দুর্গা পুজোর আয়োজন করে আসছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। রীতিমতো বিখ্যাত এই পুজো। প্রতি বছরই পুজোর সন্ধ্যায় বিভিন্ন জমকালো সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছর সেই জুহুর দুর্গাপুজোর ২১ বছর। পুজোর শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। এরই ফাঁকে আজকাল ডট-ইনের সঙ্গে পুজোয় ফেলে আসা নানান স্মৃতিতে নেড়েঘেঁটে দেখলেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
"পুজো নিয়ে আমার প্রচুর স্মৃতি। পুজো আসছে, পুজো আসছে-এই আনন্দটা কী দারুণ যে লাগত। পুজোর দু'তিন মাস আগে থেকেই তখন মনের মধ্যে ওই অদ্ভুত উন্মাদনাটা শুরু হয়ে যেত। নতুন জামা, নতুন জুতো পাব ওটা বড় আকর্ষণ ছিল সেই বয়সে। কেনাকাটার সময় আমাদেরও নিয়ে যেতেন বাড়ির বড়রা। বাবা, ঠাম্মা থাকতেন। কারণ আমার ১৩ বছর বয়সেই মা মারা গিয়েছিলেন। যাই হোক, নিজের হাতে বাছাই করে পোশাক কিনছি এটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল আমার কাছে, ওই বয়সে। রাতে বিছানায় যখন ঘুমোতে যেতাম ওই নতুন পোশাক, জুতো বালিশের পাশে যত্ন করে রেখে দিতাম। পুজোর কোন দিনে কোন পোশাকটা পড়ব সেটা নানান হিসাব কষে, ভেবে রাখাটাও একটা বড় মজার কাজ ছিল। হয়তো সপ্তমীর দিন ধুতি-পাঞ্জাবি, নবমীর দিন সিল্কের শার্ট...এরকম আর কি..."
"আর পুজোর সময় পাড়ায় নাটক হত। কোনও বছরে 'ঔরঙ্গজেব' হচ্ছে তো কোনও বছর 'আলমগীর'। সেই সময়ে বেশিরভাগ ঐতিহাসিক সব নাটকই ওই সময়ে মঞ্চস্থ হত। অসম্ভব উত্তেজিত থাকতাম তা দেখব বলে। ম্যাডক্স স্কোয়ারে আমার মাসির বাড়ি ছিল। সেখানেই হত ওই নাটক। আমার মা চলে যাওয়ার পর মাসিই আমাকে মায়ের আদরে বড় করেছিলেন। তিনি আমার জন্মদাত্রী মায়ের থেকে কিন্তু কোনও অংশে কম ছিলেন না। মাসতুতো ভাই-বোনেদের সঙ্গে চুটিয়ে মজা করতাম ম্যাডক্সের মাঠে। আর...আর...একেক সময় ম্যাডক্সের মাঠেই ত্রিপল টেনে, পর্দা লাগিয়ে পুজোর রাতে সিনেমা দেখানো হত। মাটিতে সবার সঙ্গে বসে চোখ গোল গোল করে তা রীতিমতো গিলতাম। কী ভাল যে লাগত। গান-বাজনাও হত। একদিন সতীনাথ মুখোপাধ্যায় তো অন্যদিন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। ছিলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। একেবারে জমাটি ব্যাপার যাকে বলে!"
বর্ষীয়ান অভিনেতার মুখে উঠে এল অটোগ্রাফ সংগ্রহ করার নেশার কথাও। সেই ব্যাপারটির সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে রয়েছে পুজো, বললেন তাও। "নামী সাহিত্যিকদের সই সংগ্রহ করতাম খুব। পুজোর সময় তাঁরা আসতেন সাহিত্য সভায়। আমার খুব প্রিয় ছিলেন সুনির্মল বসু, বিরাট শিশু সাহিত্যিক ছিল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়েরও সই সংগ্রহ করেছিলাম। তৎকালীন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতির সইও আমার অটোগ্রাফ খাতায় ছিল। আর..আর...শৈলেন মান্নার সইও নিয়েছিলাম। ওঁরা সব আসতেন ম্যাডক্সের গুণীজনদের সভায়। জানেন, ছোট থেকেই আমার গান বাজনা, নাটকের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। সেটা আরও টের পেয়েছিলাম পুজোয় এই অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে। পরে যখন অভিনয়কে পেশা করি এবং 'রংমহল' গ্রূপে যোগ দিই, চুটিয়ে নাটক করেছি সেই সময়। তখন পুজোর সময় করতাম 'কম্বিনেশন নাইট'। তখন আমি সেই দলে এক্সট্রা অভিনেতা হিসাবে কাজ করি। বড়-বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একটি নাটকে সবাই মিলে নানা চরিত্রে অভিনয় করতেন। ঠিক পুজোর আগে আগে হত। অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র, জহর গাঙ্গুলি, ছবি বিশ্বাস-কাকে ছেড়ে কার কথা বলব...এঁরা সব 'কম্বিনেশন নাইট' অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন। ওহ সে এক ব্যাপার ছিল বটে! সারারাত ধরে সেসব দেখতাম।"
আর পুজোর প্রেম? শোনামাত্রই লাজুক হাসি হেসে উঠলেন একসময়ের সুপুরুষ তারকা। হাসি থামলে বলে উঠলেন, "এখন লজ্জা লাগে এসব বলতে। হ্যাঁ, পুজোর সময় বহু সুন্দরী যুবতী ভাব জমাতে আসতেন। নিজে থেকেই তাঁরা কথা বলতেন। আমি তখন বেশ লাজুক স্বভাবের ছিলাম। তবু টুকটাক কথা তো হতই। কেউ কেউ তো আইসক্রিমও খাওয়াত। সেটা যে তো কত বড় ব্যাপার ছিল তা আজকালকার সময়ে বোঝানো খুব শক্ত। আমার কি ভাল লাগত না? নিশ্চয়ই লাগত! মেয়েরা নিজে থেকে খোঁজখবর নিচ্ছে, ভাল না লেগে পারে... অবশ্য বয়সে বড় মেয়েরা গাল টিপে আদর করলে খুব রেগে যেতাম!"
"...এরপর ধীরে ধীরে অভিনেতা, তারপর তারকা হলাম। বাংলা ছবির পর চুটিয়ে বোম্বেতেও কাজ করা শুরু করলাম। তবে যতই সারা বছর শুটিং করি না কেন, পুজোর পাঁচ দিন কোনও কাজ নয়। সোজা কলকাতায় গিয়ে হুল্লোড়। বোম্বের সব প্রযোজকদের আগে থেকেই বলা থাকত এই কথা। পুজোর সময় আমি কিছুতেই থাকব না বোম্বে। আর কলকাতায় পুজোয় তখন বড় বড় প্যান্ডেল, ঠাকুর-সব দেখতাম ঘুরে ঘুরে। তবে মাঝরাতের পর। আসলে, ভিড় টিড় জমে যেত আমাকে দেখলে...সবার অসুবিধা হত, তাই ওই সময়ে ঘুরতে বেরোতাম। একবার...একবার একটা কাণ্ড হয়েছিল। আউট্রাম ঘাটে গিয়েছি, পুজোর সময় একটি ছেলে কীভাবে যেন আমাকে চিনে ফেলে, ব্যস! আমার গাড়ি ঘিরে মুহূর্তের মধ্যে লোকে লোকারণ্য। তখন গাড়ি থেকে বসে শুধু লোকের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কে যেন আবার গাড়ির ছাদের উপর উঠে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে আমার ড্রাইভার তখন ভয়ে-আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে। যাই হোক, সেই সময় আমাকে বাঁচিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। লাঠিচার্জ করতে হয়েছিল সবার উপর। তারপর... তারপর, ওই জায়গা থেকে আমাকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এও তো পুজোর অভিজ্ঞতা।"
"শেষদিন উত্তর কলকাতার ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। তারপর প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা তো ছিলই। কোনওদিন রবি ঘোষের সঙ্গে তো কোনওদিন অনুপকুমার। ওদের বাড়িতে গিয়ে মজা করতাম। কখনও ওরা চলে আসত আমার কাছে। পুজোর সময় পার্ক হোটেলে ওই পাঁচ দিন আমি একটা কামরা বুক করে রাখতাম। সেখানেও খানাপিনা হত জমিয়ে। শমিত ভঞ্জ, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়রা চলে আসত। জানত, আড্ডার সঙ্গে উৎকৃষ্ট সুরাপানও হবে..." পুরনো কথা বলতে বলতে হেসে ফেললেন বিশ্বজিৎ।
সামান্য থেমে ফের বলা শুরু করলেন, "উফ্! কী মজাই যে হত। জানেন, একদিন উত্তমকুমারও এসেছিলেন পার্ক হোটেলে। আমি কলকাতায় এলে উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা হবে না, এই চিন্তাটাই অকল্পনীয় ছিল। আমি ওঁর কাছে যেতে না পারলে উনি চলে আসতেন আমার কাছে! বেণুও আসত। একদিন হয়ত ফোন করে বলল, 'তোর দাদা আসতে চাইছে।' আমিও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠতাম, 'এটা জিজ্ঞেস করার কী আছে? যেকোনও সময়ে চলে আসুক। তুইও আয়।' তারপর আসতেন আর শুরু হত আড্ডা। আর যদি মদ্যপান শুরু করতেন তো ব্যস ঘড়ি দেখতেন না। সঙ্গে তো জমাটি আড্ডা আছেই। বেণু, আমার কারও কথাই শুনতেন না। খেতেও বড্ড ভালবাসতেন। আর কী খাবেন, না যেগুলো ওঁর শরীরে জন্য খারাপ, সেগুলোই। গলদা চিংড়ি, কষা মাটন, ইলিশ ভাপা... বারণ করলেই বলত, 'একটু খাই, খাই না রে?' এসব শুনে না করা যায়... পুজোর সঙ্গে এও তো আমার উত্তম স্মৃতি..."