• বাংলা ভাষার আকর খুঁজে দিল একটি চিনা ডিকশনারি
    এই সময় | ০৫ অক্টোবর ২০২৪
  • আজও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে পড়ানো হয়, চর্যাপদ-ই বাংলা ভাষার প্রাচীনতম আকর। কিন্তু সে তো বড় জোর হাজার বছরের পুরোনো হবে। ধ্রুপদী তকমা পেতে ভাষার প্রামাণ্য নথি হতে হবে অন্তত দেড় থেকে দু’হাজার বছরের পুরোনো। ২০২২-এ বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার তকমা দিতে যখন উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের অধীনে থাকা ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ় অ্যান্ড রিসার্চ বা আইএলএসআর কাজ শুরু করে, তখন তাদের কাছে কার্যত কোনও ক্লু-ই ছিল না যে, বাংলা ভাষার অতীত কোথা থেকে খুঁড়ে বের করা হবে।শুধু ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ (ওডিবিএল) বইয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল, বাংলা ভাষার উৎপত্তি আদৌ ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে কি না! সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রাত জেগে বিস্তর বইপত্র, নথি ঘাঁটার পরে ভাষাতাত্ত্বিক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি প্রবন্ধে গবেষকরা জানতে পারেন প্রাচীন চিনে তৈরি সংস্কৃত-চিনা ডিকশনারিতে নাকি বহু বাংলা শব্দের রেফারেন্স রয়েছে। আর সেই চিনা ভাষার ডিকশনারিই অবশেষে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী তকমা পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে দিল অনেকখানি। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা দেওয়া নথিতে তাই দাবি করা হয়েছে, বাংলা ভাষার ইতিহাস কমপক্ষে ২৬০০ বছরের পুরোনো।

    আইএলএসআর-এর অধ্যাপক অমিতাভ দাস জানাচ্ছেন, শহীদুল্লাহর লেখায় বলা ছিল, ১৯২৯ সালে প্রবোধ চন্দ্র বাগচি প্যারিস থেকে এই প্রাচীন চিনা ডিকশনারির একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন। সেই সংস্করণ কোথায় পাওয়া যায়, তা নিয়ে শুরু হয় খোঁজ। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরে জানা যায়, বেশি দূরে নয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েই সেটির একটি কপি রয়েছে। আইএলএসআর-এর গবেষকরা ছুটে যান সেখানে। খুঁজে বের করা হয় চিনা শব্দকোষের লেখক লিয়েন-এর লেখা সেই প্রাচীন ডিকশনারির কপিটি। যেটা প্রকাশিত হয়েছিল প্যারিস থেকে। তবে তার পরও জট ছাড়ানো গেল না। কেন?

    অমিতাভর কথায়, ‘অষ্টম শতাব্দীতে যখন চিন দেশে বসে এই ডিকশনারি লিখছেন লিয়েন, তখন তিনি চিনা বোন অ্যান্ড ওরাকল লিপি ব্যবহার করেছিলেন। যে লিপি বহু দিনই অপ্রচলিত এবং প্রায় বিলুপ্ত। চিনা ভাষা পড়তে পারেন এমন অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমরা কথা বলি। কিন্তু কিছুতেই সেই লিপির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না।’ অবশেষে এক-দেড় মাসের অপেক্ষার পরে অমিতাভরা ব্যাক ক্যালকুলেশন শুরু করেন।

    কেমন সেটা? তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রবোধ চন্দ্র বাগচির প্রকাশিত সেই বইয়ের একদম শেষে একটি ফোলিয়ো ছিল। যে ফোলিয়োটি রোমান হরফে লেখা। ডিকশনারিতে ব্যবহৃত লিপিগুলির সঙ্কেত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয় সেই ফোলিয়োতে। সেই ফোলিয়োর পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। জানা যায়, প্রাচীন এই চিনা ডিকশনারিতে ৫২টি বাংলা শব্দের উপস্থিতি রয়েছে। তার মধ্যে ছিল, ‘মাংস, আইসো, বইসো, ভাতার, মোটা’ জাতীয় বাংলা শব্দ। আর এটাই ছিল গবেষকদের প্রথম ব্রেক থ্রু।

    অমিতাভর কথায়, ‘বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের সঙ্গে বাংলা, তিব্বত, চিনের যোগাযোগ ছিল নিবিড়। সম্ভবত সেই সূত্রেই বাংলা শব্দ ঢুকে পড়েছিল চিনা ডিকশনারিতে। অষ্টম শতাব্দীতে তা লেখা হয়েছে মানে সেই ভাষার প্রসার আরও কয়েকশো বছরের পুরোনো, এ কথা ধরাই যায়।’

    তবে জার্নিটা এখানেই থেমে থাকেনি। প্রাচীনত্ব প্রমাণের তাগিদে এই ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ঘুরে বেরিয়েছেন দাঁতন থেকে তাম্রলিপ্ত, চন্দ্রকেতুগড়-সহ রাজ্যের নানা প্রান্তে। ওপার বাংলার বর্তমানে বোগড়া এলাকার মহাস্থানগড় শিলালিপির উপরে চোখ পড়ে গবেষকদের। বাংলাদেশে ছুটে যান গবেষকরা। সেই শিলালিপি লেখা হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই শিলালিপি লেখা হয়েছিল ব্রাহ্মী লিপি ব্যবহার করে। যার মধ্যে দুর্ভিক্ষের কারণে নগরপালিকার কিছু নির্দেশাবলি ছিল।

    সেখানেই ‘সংবঙ্গীয়’ শব্দের উল্লেখ ছিল। যা থেকে প্রমাণিত হয় বঙ্গীয় ভাষা গোষ্ঠীর উপস্থিতির। যা এই ভাষা ও জাতির প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে। এ ছাড়াও সম্রাট অশোকের শিলালিপিতেও ‘দ্বাদশ’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এটা প্রাচীন বাংলার কথ্য রীতিকে প্রমাণ করছে তা-ও নিশ্চিত হয়ে বলা যায়। এই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে জড়িত ভাষাবিদ রাজীব চক্রবর্তীর সংযোজন, ‘এ ছাড়াও আমরা এমনও অনেক নথি পেয়েছি, যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রাচীন মিশরীয় ভাষার অনেক শব্দ বাংলায় সংযুক্ত হয়েছে। যা থেকে প্রমাণিত হয়, বাণিজ্যের কারণে বাংলা ভাষার সঙ্গে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতারও যোগাযোগ রয়েছে।’

    এই সমস্ত নথি এক করেই ২২০০ পাতার চারটি ভলিউমে একটি নথি তৈরি করে আইএলএসআর। যার ওজন দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১২ কেজি। সংস্থার অধিকর্তা স্বাতী গুহর কথায়, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই নথি আমরা দিল্লিতে গিয়ে জমা করি। অবশেষে তার স্বীকৃতি এসেছে। রাজ্য সরকার ও উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সহায়তা না পেলে এটা আমরা তৈরি করতে পারতাম না।’ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু এক্স হ্যান্ডলে এই স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এই গবেষণা সংস্থাকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন।
  • Link to this news (এই সময়)