পুজোর প্রাচীন প্রবাদের সঙ্গে জড়িয়ে উত্তর কলকাতার তিন বনেদি বাড়ি, রইল সেই ইতিহাস
প্রতিদিন | ০৫ অক্টোবর ২০২৪
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বাংলার প্রাচীন বাংলার প্রবাদ আছে, মা মর্ত্যে এসে পোশাক পরেন ও সাজেন শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে। খেতে যান কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্র বাড়িতে। রাত জেগে নাচ দেখেন শোভাবাজার রাজ বাড়িতে। একথার প্রচলন হওয়ারও কারণ রয়েছে। তৎকালীন সময়ে এই বনেদি বাড়িগুলির প্রথমটায় মাকে সাজানো হত বিপুল গয়না দিয়ে। কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে কত মনের চালের ভোগ হত তার ইয়ত্তা নেই। শোভাবাজারে সারা রাত বসত নাচের আসর। সেই থেকেই এই প্রবাদগুলির প্রচলন হয়েছে বলে মনে করা হয়।
এই তিনটি বাড়িতে সেই বহর আগের থেকে কমলেও আজও নিয়ম মেনে পুজো হয়ে আসছে। আজকের প্রতিবেদনে রইল তিনবাড়ির পুজোর হদিশ:
জোড়াসাঁকো শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ি: কলকাতা জোড়াসাঁকো শিবকৃষ্ণ দাঁ পরিবারে পুজো শুরু হয় ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দে। পুজো শুরু করেন গোকুলচন্দ্র দাঁ। গোকুলচন্দ্র দাঁর প্রাচীন বাস ছিল বর্ধমানের সাতগাছিয়াতে। সেখানে আজও মন্দির-মূর্তি বর্তমান। সেখানে পুজো কতকাল ধরে চলেছিল সে বৃত্তান্ত অজানাই। গোকুলচন্দ্রের দত্তক পুত্র ছিলেন শিবকৃষ্ণ দাঁ। তাঁর আমলকেই দাঁ পরিবারের স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়। পারিবারিক লোহা, কয়লা আর হার্ডওয়ারের ব্যবসায় প্রভূত লাভ করেন শিবকৃষ্ণ। বহরে বাড়ে দুর্গাপুজো।
পরিবারের এই সদস্য সাজতে ভালোবাসতেন। ঠিক করেছিলেন মাকেও সাজাবেন। সেই মতো ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে বিশেষ কাজ করা অলঙ্কার ও পোশাক আনালেন ঠাকুরকে পরানোর জন্য। সেই পোশাকে ভারী সোনালি রুপোলী জরির কাজ আর কিছু দামি পাথর খচিত ছিল। পোশাক এবং দেবীর অলঙ্কার এতটাই সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর ছিল যে তখন মুখে মুখে চালু হয়ে গিয়েছিল যে দেবী মর্ত্যে এসে প্রথম দাঁ বাড়িতে পোশাক এবং অলঙ্কার পরে সাজেন।
রথের দিন গড়ানকাঠ পুজোর মধ্য দিয়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামোতে দেবীর মস্তক স্থাপন করা হয়। অন্য দেবদেবীর মস্তক স্থাপন হয় পরে।পটুয়ারা তৈরি করেন দেবীর চালচিত্র। তেরোটি শাড়ি ও তেরোটি কাঁসার পাত্র দিয়ে দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়াও একশো আটটি পেতলের প্রদীপ সাজানো হয়। বৈষ্ণব ধর্মে পুজো হয়। হয় না কোনও বলি। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয় ধূমধাম করে।
কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্র বাড়ি: প্রায় ২১৮ বছর আগে কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্র বাড়িতে পুজো শুরু হয়। রাধাকৃষ্ণ মিত্র এই বাড়িতে পুজো শুরু করেন। রথের দিন কাঠামো পুজো করে বাড়িতেই দেবী প্রতিমা তৈরি হয়। কুমোরটুলি থেকে আসে ডাকের সাজ। প্রতিপদে বোধন। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত এই বাড়িতে হয় কুমারীপুজো। অষ্টমীতে হয় কল্যাণী পুজো। সাধারণত ১০৮ টি পদ্ম সন্ধিপুজোয় ব্যবহৃত হয়। তবে দর্জিপাড়ার মিত্রবাড়িতে ১০৮টি অপরাজিতা ফুল দিয়ে হয় পুজো। নবমীতে হোম এবং প্রদক্ষিণ। এই বনেদি বাড়িতে ভোগের ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। রোদে শুকনো মুগডাল দিয়ে আজও খিচুড়ি তৈরি হয়। নৈবেদ্যর তালিকায় থাকে ভাজা সবজি। মাখনের নৈবেদ্য হল এই বাড়ির ভোগের অন্যতম আকর্ষণ। তা আজও প্রতিমাকে নিবেদন করা হয়। নিবেদন করা হয় ৩০ থেকে ৫০ মণ চালের নৈবেদ্য। এছাড়াও থাকে নানা রকম মিষ্টি, গজা, নিমকি,লুচি, রাধাবল্লভীর ইত্যাদি খাবার। সেই খাবারের বহর এতটাই যে মনে করা হয় শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে পোশাক ও গয়না পরার পর এখানে মা ভোজন করেন।
শোভাবাজার রাজ বাড়ি: ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ। হারলেন সিরাজ। মনে করা হয় সেই হারের পিছনে হাত ছিল রাজা নবকৃষ্ণ দেবের। ইংরেজরা চাইল এই যুদ্ধের বিজয়োৎসব পালন করতে। বিজয়োৎসবের ভার পড়ল নবকৃষ্ণের উপর। শোভাবাজার রাজবাড়িতে গড়ে উঠল ঠাকুরদালান। শুরু হল দুর্গাপুজো। নাচগানের সঙ্গে থাকল সাহেব ও গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য পানভোজনের অঢেল আয়োজন।
এদিকে ৩৬ বছর পর্যন্ত নবকৃষ্ণের কোনও সন্তান না হওয়ায় ১৭৬৮ সালে দাদার ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নেন তিনি। ১৩ বছর বাদে রাজার পঞ্চম রানি জন্ম দিলেন পুত্র রাজকৃষ্ণের। পণ্ডিতেরা গণনা করে বললেন, রাজকুমারের পক্ষে উত্তরের বাড়ি মঙ্গলজনক নয়। নবকৃষ্ণ গড়ে তুললেন দক্ষিণের ছয় মহলা বাড়ি। রাজা নবকৃষ্ণ প্রথমে উত্তরদিকের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরে দক্ষিণদিকের বাড়িটাতেও ১৭৯০ সালে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন। ওই বছরই সম্পত্তি ভাগাভাগি হয় গোপীমোহনের সঙ্গে রাজকৃষ্ণের। এর পর থেকেই দুই বাড়িতে আলাদা পুজো শুরু হয়। উত্তরদিকেরটি গোপীমোহনের ছেলে রাধাকান্ত দেবের আর দক্ষিণ দিকেরটি রাজকৃষ্ণ দেবের পুজো বলে চিহ্নিত করা হয়।
রাধাকান্তের বাড়িতে রথের দিন ও রাজকৃষ্ণের বাড়িতে উলটোরথের দিন কাঠামো পুজো করে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। দুবাড়িতেই ডাকের সাজের একচালার মূর্তি। রাধাকান্ত দেবের বাড়ির প্রতিমার সিংহটি সাদা রঙের ঘোড়ামুখো সিংহ। যাকে বলে নরসিংহ। মহিষাসুর সবুজ বর্ণের। রাজকৃষ্ণদেবের বাড়ির প্রতিমার সিংহটি স্টিলরঙা ও মহিষাসুরের রং সবুজ।দুর্গানবমীর ঠিক আগের নবমীতে বোধন হয়। সপ্তমীর সকালে একটা রুপোর ছাতা মাথায় নিয়ে নবপত্রিকাকে বাগবাজারের ঘাটে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধিক্ষণের পুজো আজও নিষ্ঠার সঙ্গে হয়। দশমীর সকালে দর্পণ বিসর্জন।
শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকেই প্রথম দুর্গাপুজোয় বাইজি নাচ শুরু হয়েছিল। টানা ১৫ দিন ধরে চলতো এই নাচ। আসতেন সমাজের গনমাণ্য ব্যক্তিরা। সেই থেকেই বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে পুজোর সময় মা দুর্গা রাত জেগে এই শোভাবাজার রাজবাড়ির নাচ দেখেন।