সুপ্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে দেখতেন শাসকদের একাংশ। উনিশ শতকের শেষ দিকে এই প্রবণতা প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলেও, সেই শতকের প্রথম দিক থেকেই সেই দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে রোমান দেবতাদের আদলে এ দেশে ব্রিটিশ শাসক ও সেনানায়কদের মূর্তি গড়ার মধ্যে। কলকাতায় রাজপুরুষের প্রথম মূর্তি ১৯০৩ সালে ময়দানে স্থাপিত মার্কুইস কর্নওয়ালিসের স্ট্যাচু। এখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে স্থাপিত মূর্তিটির আঙ্গিক, ভঙ্গি ও পরিধানে রোমান বীরের ছায়া চোখ এড়ায় না। ব্রিটিশ রাজের বিজয়বার্তার ঘোষক, ভিক্টোরিয়ার মেমোরিয়ালের বিখ্যাত পরির রূপায়ণের পিছনেও সেই প্রেরণার ধারাবাহিকতা।
নিজ শাসনের গৌরব ঘোষণায় ঔপনিবেশিক শাসকরা নিত্যনতুন মূর্তি বসিয়েছেন। সেই সব মূর্তি শোভা বাড়িয়েছে সে আমলের ময়দান, পার্ক বা গভর্নমেন্ট হাউস, টাউন হল, মেডিক্যাল কলেজ, টেলিগ্রাফ অফিস-সহ নানা সরকারি ভবনের। তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক, স্বীকার করতে হয় যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই সব মূর্তি ছিল ভাস্কর্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
স্বাধীনতার পরে শহর থেকে ঔপনিবেশিক শাসকদের মূর্তি সরিয়ে কিছু বসানো হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। কিছু পাঠানো হয় ব্যারাকপুর লাটবাগানে, কিছু হারিয়ে যায় চিরতরে। শুরু হয় ভারতের দেশনায়কদের মূর্তি বসানোর যুগ। তবে রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে কলকাতার পথপার্শ্বের মূর্তিদের গুরুত্ব থেকে যায় আগের মতোই।
সর্বজনীন পুজোয় মূর্তিতেই চিন্ময়ীর আরাধনা। দৈব অনুষঙ্গ থাকলেও, প্রথা মেনে বিসর্জন হওয়ায় তার আয়ু ক্ষণস্থায়ী। রাজপথের মূর্তি যেমন রাজনৈতিক গৌরবের প্রতীক, তেমনই মাটির দুর্গামূর্তিও দুর্গোৎসব ঘিরে শিল্প-মহোৎসবের প্রতীক। সেই সূত্র ধরেই কলকাতার নানা জায়গায় স্থাপিত মূর্তির নির্মাণ-ইতিহাস এবং সামাজিক গুরুত্বের অন্বেষণকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছে এই বছর ‘পূর্বাচল শক্তি সঙ্ঘ’-এর পুজোর ভাবনা— ‘কলকাতার মূর্তিকথা’।
থিম-সজ্জার ভাবনা ছাড়িয়ে এখানে লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিকের গড়নে ছাপ ফেলেছে রাইটার্স বিল্ডিং-এর ছাদে বসানো ঔপনিবেশিক আমলের মূর্তিরা। শাস্ত্রীয় ভাবনায় দেবী ও নদী হিসাবে সরস্বতীর কল্পনায় খুব সহজেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। তাই সরস্বতীর রূপকল্পে ছায়া ফেলেছে রাইটার্স-এর ছাদের ‘সায়েন্স’ মূর্তি। সেখানেই বসানো ‘এগ্রিকালচার’ বা কৃষির মূর্তিভাবনায় গড়া হয়েছে লক্ষ্মীকে। কৃষকের মধ্যে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতাকে খুঁজে পেয়ে, সেই আদলে গড়া হয়েছে দেবসেনাপতি কার্তিককে, মুখে গ্রিসের ডেলফির সারথিমূর্তির আদল। পার্থ দাশগুপ্তের পরিকল্পনা, দেবদত্ত গুপ্তের গবেষণাসমৃদ্ধ এই আয়োজনে এক দল শিল্পী, কারিগর, গবেষক মিলে কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মূর্তির ইতিহাস একসূত্রে গেঁথেছেন দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণে। এ এক যৌথ শিল্পযাপনের আখ্যান, কীর্তিমানের মূর্তিমান হয়ে ওঠার সূত্রসন্ধান। উপরের ছবিতে মণ্ডপে দুর্গার দু’পাশে দুই শিল্পীর হাতে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর ‘নির্মাণপর্ব’।