অর্ণব দাস, বারাকপুর: সেই কবে শরতে রামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন সীতাকে উদ্ধারের জন্য। সেই থেকে শারদীয়া দুর্গোৎসবের চল। রীতিনীতি মোটের উপর এক থাকলেও বনেদি বাড়ির পুজোগুলোয় তার হেরফের হয় বইকি। আর সেদিক থেকে কামারহাটিতে নেতাজি অনুগামী কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো একাধিক চমকে ভরা। এবছর, শতবর্ষে নতুন কিছু করছেন পরিবারের সদস্যরা। তাই এবছর স্থানীয়দের বিশেষ নজরে রয়েছে কামারহাটির এই পুজো(Durga Puja 2024)।
কামারহাটি পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ঠাকুর দাস চ্যাটার্জি রোডের বাসিন্দা কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পরিবার। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী ছিলেন তিনি। তাঁর পরামর্শেই এই পরিবার ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতি বছর দেবী দুর্গার আরাধনা করে। এবছর তাঁদের পুজো একশো বছরে পড়েছে। এই এলাকায় মূলত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস হলেও তাঁরাও চট্টোপাধ্যায় বাড়ির সঙ্গে এই দুর্গোৎসবে শামিল হন। এলাকায় এই পুজো আরও বিশেষ কারণে খ্যাত। ষষ্ঠী থেকে নবমী প্রতিদিনই এই পুজোয় আখ, চালকুমড়ো, কলা বলি দেওয়া হয়। নবমীর বলির পরে মাটির তৈরি বলির বেদি ভেঙে ফেলে সেই মাটি দিয়েই হয় ‘মাটি খেলা’। এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। তার পর সকলে করেন গঙ্গা স্নান। পরিবার ও স্থানীয়দের বিশ্বাস, এতে রোগ নিরাময় হয়। আর দশমীতে হয় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বিবাহিত সদস্যদের সঙ্গে অবিবাহিতদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ! এটা তো নজিরবিহীন বটেই। তার পর হয় সিঁদুরখেলা ও প্রতিমা নিরঞ্জন। পুজো করা থেকে ভোগ রান্না সবটাই করেন পরিবারের সদস্যরা।
১৯৭১ সাল থেকে পুজো করছেন পরিবারের সদস্য কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিন বছর বাদ দিলেন প্রতি বছরই তিনি পুজো করেছেন। এবছর তাঁর ৫০তম পুজো। আগামী বছরে তাঁর প্রথম সন্তান সম্পদের উপর এই পুজোর ভার। পাঁচ পুরুষ ধরে আজও বর্ধমানের আকুই গ্রাম থেকে ঢাক বাজাতে আসেন ঢাকিরা। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, এই বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ভাই স্বাধীনতা সংগ্রামী সুরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী। বরানগর বোমা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত এই সুরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সি জেলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গেই বন্দি ছিলেন। চার বছর বক্সার জেলেও ছিলেন তিনি।
রামচন্দ্রবাবুর নাতি তুষার চট্টোপাধ্যায়। তিনি আবার কামারহাটি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান। তুষারবাবু জানিয়েছেন, সুরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২৫ সালে বাড়িতে যখন দুর্গাপুজো শুরু করবেন বলে ভাই সুরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুমতি চান, তখন উনি (সুরেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) শর্ত দিয়েছিলেন, ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে প্রসাদ নিতে সকলকে আসতে হবে। কেউ যেন ফিরে না যান। সেই প্রথা মেনে আজও পুজো চলছে। পরিবারের কেউ কানাডা, কেউ বস্টন, কেউ আবার ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্কে থাকেন। অনেকের বাস ক্রোয়েশিয়া, আবুধাবি বা দুবাইয়ে। মুম্বই, বেনারস, গুজরাটে বসবাসকারীর সংখ্যাও কম নয় নেহাৎ। মাস খানেক আগে ‘জুম’ কলে পুজোর বৈঠকে সকলেই উপস্থিত থাকেন। সেখানেই পুজোর চূড়ান্ত রূপরেখা ঠিক হয়। তুষার চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “বৈঠকের মতো পুজোর অঞ্জলি থেকে সব অনুষ্ঠানেও বাইরে থাকা পরিবারের সদস্যরা ভিডিও কলে অংশ নেন।”
তবে নিয়ম ও নির্ধারিত সময়ে পুজোর আচার মানার ব্যাপারে যথেষ্ট কড়া পরিবারের সদস্যরা। এমনটাই জানিয়েছে পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম তথাগত জানান, ”পুজোর প্রতি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান হয়। পরিবারের সকলে তাতে অংশ নেন। প্রতিবছর একই অস্ত্র দিয়ে মা দুর্গাকে সাজানো হয়। পরিবারের সদস্যরাই কাঁধে করে নিরঞ্জনে নিজে যায়। আমাদের একচালা ঠাকুর, শতবর্ষের কারণে এবছর সাদা ডাকের সাজ হচ্ছে।”