‘মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে মা’, আদিবাসী রমণীর দুর্গাপুজো, দেবী আরাধনায় মাতৃভাষায় মন্ত্র তৈরি করেছেন সরস্বতী!
আনন্দবাজার | ০৬ অক্টোবর ২০২৪
সংস্কৃত মন্ত্র জানা নেই। ব্রাহ্মণ পুরোহিতের বালাই নেই। নিজের ভাষায় নিজের তৈরি মন্ত্রেই সারা বছর পর্ণকুটিরে দুর্গার আরাধনা করেন এক আদিবাসী মহিলা। ‘ব্যতিক্রমী’ এই পুজো দেখতে বাংলা তো বটেই, ভিন্রাজ্য থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় করেন বাঁকুড়ার হিড়বাঁধ ব্লকের দোমোহানি গ্রামে।
দোমোহানির বাসিন্দা সরস্বতী হাঁসদা। তবে তাঁর বাড়ি এখানে ছিল না। বিয়ে সুখের হয়নি। দাম্পত্য কলহ, সাংসারিক অশান্তির জন্য অনেক বছর আগে শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন। কিন্তু যাবেন কোথায়? কী-ই বা করবেন? এক আত্মীয় সাহায্য করেছিলেন সরস্বতীকে। সেই সাহায্য নিয়েই দোমোহানি গ্রামে উঠেছিলেন সাঁওতাল রমণী। গ্রামের এক প্রান্তে একচিলতে একটি জমিতে মাটির বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই বছর কুড়ি ধরে দুর্গাপুজো করছেন তিনি।
আদিবাসীরা পৌত্তলিকতার বিরোধী। কিন্তু সরস্বতী কেন দুর্গার পুজো করেন? মহিলার কথায়, ‘‘বছর ২০ আগে এক রাতে স্বপ্ন দেখলাম। দেবী নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাই...।’’
প্রথম প্রথম দুর্গাপুজো করতে গিয়ে অনেক ঠোক্কর খেয়েছেন সরস্বতী। নিজের মধ্যেও প্রবল দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এক বার নয়, বার বার একই স্বপ্ন দেখেছেন সরস্বতী। তাই সিদ্ধান্ত নেন, আদিবাসী সমাজ যা-ই বলুক, তিনি দুর্গাপুজোর আয়োজন করবেন। সেই শুরু।
পুজোর শুরুতেই বাদ সাধে আদিবাসী সমাজ। সমাজপতিরা দ্বারস্থ হন পুলিশের। মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। জিত অবস্থ সরস্বতীরই হয়। বাঁকুড়ার আদিবাসী গ্রামে সরস্বতীর বাড়ির উঠোনে পর্ণকুটির শুরু হয় দেবী আরাধনা। পূজারীর আসনে বসেন স্বয়ং সরস্বতী। চিরাচরিত সংস্কৃত মন্ত্রে নয়, সরস্বতী তাঁর মাতৃভাষায় তৈরি মন্ত্রে মায়ের পুজো করেন। সরস্বতীর কথায়, ‘‘মা বার বার স্বপ্নে বলেছিল, ‘আমি তোর হাতেই পুজো নেব।’ আমি মা কে বলেছিলাম, ‘আমি তো পুজোর কোনও নিয়ম বা মন্ত্র জানি না!’ মা বলেছিল, ‘তুই ভক্তি, শ্রদ্ধা ভরে আমায় ডাকিস। যে ভাবে তুই ডাকবি, তাতেই আমার চলবে।’ তাই কোনও পুরোহিত দিয়ে নয়, নিজের হাতে রোজ সকালে স্নান করে ফুল-বেলপাতা দিয়ে নিজের ভাষাতেই মাকে ডাকি। প্রায় আধ ঘণ্টা পুজো করি। মন্ত্রের সারমর্ম হল, জগৎ সংসারের সমস্ত দেবদেবীগণ এই জগতের সকলকে ভাল রাখো। সকলের মঙ্গল করো মা।’’
সারা বছরই সরস্বতীর ওই মন্দিরে ভক্তদের আনাগোনা থাকে। তবে দুর্গাপুজোর চার দিন বিভিন্ন জেলা থেকে পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ড থেকেও সরস্বতীর দুর্গাকে দেখতে আসেন অনেকে। সরস্বতীর পর্ণকুটিরে দুর্গা সপরিবারে প্রতিষ্ঠিত। মাটির তৈরী ওই প্রতিমার বিসর্জন হয় না। দুর্গাপুজোর সময় আলাদা একটি প্রতিমা তৈরি করে সেটির পুজো করেন সরস্বতী। দশমীতে সেই প্রতিমার বিসর্জন হয়। প্রতি দিন নিজের হাতে গোবর জল দিয়ে কুটিরের চারপাশ নিকানোর কাজ থেকে আলপনা আঁকা, নিত্যপুজো থেকে ভোগ নিবেদন সবই একা হাতে করেন সরস্বতী। ভোগ হিসাবে থাকে চিঁড়ে আর বাতাসা।