বৃষ্টি উড়িয়ে ফাটাফাটি ফুটবল, নিউ মার্কেট থেকে ব্যাগ নিয়ে প্রতিবাদ মঞ্চে
এই সময় | ০৭ অক্টোবর ২০২৪
মণিপুষ্পক সেনগুপ্ত
শেষ বলে ছক্কা। একে চতুর্থী, তায় রবিবার। এ বারের পুজোর হিসেব-নিকেশ বেশ গোলমেলে। আজ, সোমবারও নাকি চতুর্থী। কাল, মঙ্গলবার পঞ্চমী।তাতে কী! সোমবার চতুর্থী (২), মঙ্গলবার পঞ্চমী এমনকী বুধবার ষষ্ঠীতেও ব্যাট হাতে নামতে পারে মানুষ। কিন্তু, রবিবার তো আর পাবে না। পুজোর আগে শেষ রবিবার বলে কথা! আর পরের রবিবার তো বাতাসে বিদায়ের সুর। এ বছরের মতো দুর্গাপুজো শেষ।
রবিবার তো কতই আসে যায়। কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে মিলিয়েও যায় ছুটির দিনটা। কিন্তু এই রবিবার যে আর পাঁচটা রবিবারের মতো নয়। পুজোর কাউন্টডাউন-পর্বের শেষ রবিবার। ফলে পুজোর 'শপিং-ম্যাচ' জিততে হলে হাতে ছিল আর একটি-ই বল - রবিবার। সেই বল 'বাপি বাড়ি যা' স্টাইলে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে শহর কলকাতা দেখিয়ে দিল সে যেমন প্রতিবাদে আছে, তেমনই উৎসবেও।
উত্তর থেকে দক্ষিণ, সর্বত্রই এক ছবি। যেন 'শপিং-ফেয়ার'। পায়ে-পায়ে উৎসব। এ দিন দুপুর থেকেই হাতিবাগান, গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেটে তিল ধারণের জায়গা নেই। শুধু কলকাতাই নয়, শহরতলি থেকেও বহু মানুষ এ দিন হাজির হয়েছিলেন শহরের গুরুত্বপূর্ণ শপিংমল এবং বাজারগুলিতে। ব্যবসায়ীদের পরিভাষায় পুজোর 'মন্দা বাজার'-এর ধাক্কা কিছুটা হলেও অক্সিজেন পেল শেষ ওভারে।
হাতিবাগানের হকার চন্দন সাউ-এর কথায়, 'অনেকদিন পর শহরটাকে চেনা লাগল। সেই উপচে পড়া ভিড়। চিৎকার-চেঁচেমেচি। দরদামের টানটান স্নায়ুযুদ্ধ। এটাই তো আমার শহর। এটাই তো কলকাতার প্রাণ।' হাতিবাগানেরই অন্য এক হকারের সংযোজন, 'আমাদের যেটুক ব্যবসা হওয়ার তা ওই পুজোর আগেই হয়। আরজি করের ঘটনায় একটা শোকের আবহ চলছে। মর্মান্তিক ঘটনা। আমাদেরও মন ভালো নেই। কিন্তু বিকিকিনি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের তো পেটে টান পড়বে। প্রান্তিক মানুষের রুটি-রুজি জড়িয়ে থাকে পুজো-উৎসবকে কেন্দ্র করে। তাই আরজি করের ঘটনা না ভুলে মানুষ পুজোর কেনাকাটা করুক, সেটা আমরা চাইছিলাম।'
রবিবার গড়িয়াহাটে পুজোর কেনাকাটার ভিড় অবশ্য টেক্কা দিয়েছে হাতিবাগানকেও। এক রসিক ক্রেতার কথায়, 'এতদিন নানা ব্যক্তিগত ব্যস্ততায় ফুরসত পাইনি। রবিবার তাই একদিনেই পুজোর কেনাকাটা সেরে ফেলেছি। হাতিবাগান ঘুরে গিন্নির সঙ্গে গড়িয়াহাটে ঘুরছি। তবে এখানে ভিড় দেখছি হাতিবাগানের থেকেও বেশি। অথার্ৎ, স্লগ ওভারে গড়িয়াহাটের রান-রেট হাতিবাগানের থেকেও বেশি। আমি তো মাঝখানে ভিড়ের মধ্যে গিন্নিকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।' গড়িয়াহাটের ব্যবসায়ী রতন দাস কথায় কথায় বললেন, 'এ বছর পুজোর বাজার প্রথম থেকেই খারাপ। আরজি কর ছাড়া আরও নানা কারণ আছে। সপ্তাহখানেক হলো বাজার ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করেছে। রবিবারের ভিড় দেখে বোঝার উপায় ছিল না দু'সপ্তাহ আগেও আমাদের মাছি মারতে হয়েছে।'
নিউ মার্কেটও ফিরেছে চেনা-ছন্দে। সেখানেও কার্যত পা ফেলার জায়গা নেই। ভিড় ঠেলেই চলেছে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা। এ দিন নিউ মার্কেট চষে বেড়ানো সোদপুরের শিপ্রা ঘোষ দু'হাতে একগুচ্ছ ব্যাাগ সামলাতে সামলাতে বললেন, 'পুজো তো উৎসব নয়। বাঙালির কাছে আরও বেশি কিছু - ঐতিহ্যও। কত পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়। উপহার দেওয়া-নেওয়া চলে। যুগ যুগ ধরে এই রীতি চলছে আমাদের পরিবারে। এতদিন পুজোর কেনাকাটা করতে বেরোয়নি। নানা কারণে মন-মেজাজ ভালো ছিল না। কিন্তু এত বছরের পারিবারিক রীতি ভেঙে দেবো! তাই পুজোর আগে শেষ রবিবার কেনাকাটার পর্বটা চুকিয়েই ফেললাম।'
মানুষের ভিড়। আলোর রোশনাই। উৎসবের আমেজ। তবুও যেন কোথাও একটা বিষাদের সুর। আরজি করের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরে প্রায় দু'মাস কাটতে চলল। কিন্তু, শহরের জোলো বাতাস ফিসফিসিয়ে বলে চলেছে - 'কই! এখনও তো বিচার পেলেন না নির্যাতিতা।' উৎসবের বাজনায় তাই চাপা পড়ে যায়নি বিচারের দাবিও। কলকাতা জানে কী ভাবে একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হয় পুজোর উৎসব আর প্রতিবাদী আন্দোলন। নিউ মার্কেটের অদূরেই মেট্রো চ্যানেলে জুনিয়র চিকিৎসকরা আমরণ অনশনে। কেনাকাটা সেরে বহু মানুষ ঢুঁ মারছেন অনশন মঞ্চেও। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে গলাও মেলাচ্ছেন 'জাস্টিস ফর আরজি কর'। বলছেন - উৎসবের রেশ কেটে গেলেও, দাবি না-মেটা পর্যন্ত আন্দোলনটা যেন চলে।