এই সময়: নিছক ভয়ভীতির রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করা কিংবা হিসেব বহির্ভূত ভাবে টাকা তোলা নয়, অভিযোগ আরও গুরুতর। নিয়মিত যৌন নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালানো, এমনকী ড্রাগ ও মদ কিনতে জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়াদের বাধ্য করার মতো অপরাধও লিঙ্গ নির্বিশেষে নিয়মিত চালিয়ে আসতেন আরজি করের থ্রেট সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এমন ৫৯ জনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অপরাধের ধরন ও বহর দেখে চোখ কপালে ওঠার জোগাড় আরজি করের স্পেশ্যাল কলেজ কাউন্সিল সদস্যদেরই। তাঁদেরই একজনের মন্তব্য, ‘এরা ডাক্তার, নাকি দাগী অপরাধী, বোঝা দায়!’কেন এত বড় কথা বললেন আরজি করের এক বিভাগীয় প্রধান— তার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে শনিবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জারি করা আদেশনামার পরতে পরতে। ২০২১-এর নভেম্বর থেকে চলতি বছরের অগস্টের গোড়া পর্যন্ত, অর্থাৎ আরজি করে সন্দীপ ঘোষ অধ্যক্ষ থাকাকালীন ওই অভিযুক্তরা ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন। তাঁদের সুরে গলা না-মেলালে অথবা মোটা টাকা নজরানা না দিলে ডাক্তারি পড়ুয়াদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার এবং হস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হতো জুনিয়রদের।
বাছাই করা ছাত্রছাত্রীদের লাগাতার যৌন নির্যাতনও চলত মাঝরাতে কিংবা ভোররাতে বয়েজ় কমন রুমে ডেকে। কখনও বেশ কয়েক জনের উপস্থিতিতে, কখনও আবার একান্তে অনেককে অশ্লীল কাজকর্ম করতে বাধ্যও করা হতো। এবং এই থ্রেট সিন্ডিকেটে পান্ডারা মাঝরাতে জুনিয়রদের বাধ্য করতেন নির্দিষ্ট ঠিকানা থেকে মাদক এবং মদ-সহ নানা নেশার জিনিস কিনে আনতে।
আর সেই নির্দেশ তামিল না-করলে?
সে ক্ষেত্রে অকথ্য জুনিয়রদের গালিগালাজের পাশাপাশি কখনও জুটত মারধর, কখনও চলত শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। উল্টে যৌন হেনস্থার মিথ্যে অভিযোগে পুলিশে এফআইআর করিয়ে দেওয়ার ভয়ও দেখানো হতো। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুরো বিষয়টা তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপকে বারংবার জানানো সত্ত্বেও কোনও লাভ হতো না। বরং তিনি অভিযুক্তদের প্রশ্রয়ই দিতেন বলে অভিযোগ। ফলে ভুক্তভোগীরা বুঝে যান, অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ জানালে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
কেউ অভিযোগ করলে তাঁকে আরও বেশি করে ‘টার্গেট’ করা হতো। ৮০ জন সাক্ষীর বয়ান ও অভিযুক্তদের পাল্টা যুক্তি বিশ্লেষণ করে আরজি করের বিশেষ তদন্ত কমিটি এ নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে। অভিযুক্ত ৫৯ জনের মধ্যে ১০ জনকে পাকাপাকি ভাবে ওই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে।
ওই ১০ জনের মধ্যে রয়েছেন সন্দীপ-ঘনিষ্ঠ সিনিয়র রেসিডেন্ট চিকিৎসক সৌরভ পাল, হাউসস্টাফ আশিস পাণ্ডে এবং ইন্টার্ন নির্জন বাগচি ও শরিফ হাসানও। আরজি করে দুর্নীতির অভিযোগে আশিসকে গ্রেপ্তারও করেছে সিবিআই। ওই ১০ জনের বিরুদ্ধে মানিকতলা হস্টেলের আবাসিক ডাক্তারি পড়ুয়াদের উপর শারীরিক ভাবে চড়াও হওয়ার অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে।
আরজি করের অধ্যক্ষ মানস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এঁদের নামের তালিকা পাঠানো হচ্ছে ইন্টার্নাল কমপ্লেন্টস কমিটি (আইসিসি) এবং অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটির কাছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী পুলিশের দ্বারস্থ হওয়া-সহ পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে। পাশাপাশি, তাঁদের মধ্যে যাঁরা চিকিৎসক, তাঁদের নামের তালিকা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে পাঠিয়ে তাঁদের ডাক্তারি রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সুপারিশও করা হবে।
পুরোটা না হলেও, যৌন নির্যাতন, হেনস্থা, র্যাগিংয়ের মতো প্রায় এই একই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আরও ২৭ জনের বিরুদ্ধেও প্রায় একই ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করা হচ্ছে। তদন্তে উঠে এসেছে, নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলে যোগদান এবং তার মিছিল-মিটিংয়ে থাকার জন্যও জুনিয়র ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়াদের উপর চাপ দেওয়া হতো। কলেজের নানা ইভেন্টের জন্য হিসেব বহির্ভূত ভাবে টাকাও তুলতেন অভিযুক্তরা। এ ছাড়া জোর খাটিয়ে টাকার বিনিময়ে হাউসস্টাফ-ইন্টার্নদের ডিউটি রস্টারও বদলে দেওয়া বা তাঁদের নেকনজরে না থাকলে অধ্যক্ষকে দিয়ে ইন্টার্নশিপের নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) আটকে দেওয়ার মতো অভিযোগও উঠেছে।