• ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ থেকে ফিরল শহরের শেষ ডাবল-ডেকার
    এই সময় | ০৭ অক্টোবর ২০২৪
  • কুবলয় বন্দ্যোপাধ্যায়

    এ ভাবেও ফিরে আসা যায়! ‘লালবাতির নিষেধ’ ছিল না। তবু ঝড়ের বেগে ধাবমান যে গণ-পরিবহণগুলো সে দিন ভয়ঙ্কর ভাবে টাল সামলে নিয়েছিল ‘কলকাতার যীশু’-কে দেখে, সেই তালিকায় ছিল ‘বাঘ-মার্কা ডবল-ডেকার’-ও। তবে মহানগরের রাজপথে সেই বাসের ঝোড়ো গতি রুদ্ধ হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। বাতিল সেই বাসগুলো একে একে স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে ঢুকে আর বেরোয়নি। বাঘমার্কা ডাবল-ডেকারের শেষতম প্রতিনিধির কপালেও হয়তো সেই পরিণতিই লেখা ছিল। কিন্তু কে জানত, অন্য গল্প লেখা হবে!রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো দিকে বিটি রোডের ধার বরাবর জায়গাটা বাসকর্মীদের কাছে ‘বাসের শ্মশান’ নামে পরিচিত। বাতিল বাসগুলোকে স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে নিয়ে গিয়ে কাটা শুরু হওয়ার আগে ওই জায়গাতেই মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকে সার সার দাঁড়িয়ে থাকা অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ বাসেরা। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল ডাবল-ডেকারের শেষ সদস্য। তার শরীরে এখনও স্পষ্ট ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএসটিসি) বাঘের লোগো।

    ফুলবাগানের স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে ‘শেষযাত্রা’য় যাওয়ার সময়ে তার উপর হঠাৎ নজর পড়েছিল ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’-র সদস্য সৌম্যদীপ মিত্রর। বাস ভালোবাসেন, কয়েক বছর আগেও যে ডাবল-ডেকার শহরে অক্লান্ত ভাবে যাত্রী পরিবহণ করেছে, এমন বাস অন্তত কয়েকটা থেকে যাক — এমনটা চান অনেকেই। ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’ তাঁদেরই সংগঠন। মৃত্যু পথযাত্রী বাসটাকে দেখে খটকা লেগেছিল সৌম্যদীপের। বাসের সামনের দিকটা সেই পুরোনো ডাবল-ডেকারের মতো নয়। তবে সে যে ডাবল-ডেকার, তাতে সংশয় নেই।

    তড়িঘড়ি ওই বাসের কয়েকটা ছবি তুলে গ্রুপের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেন তিনি। সৌম্যদীপ বুঝেছিলেন, বাস যখন ‘শ্মশানে’ এসে গিয়েছে, তখন ‘চিতায় ওঠা’ সময়ের অপেক্ষা মাত্র। গ্রুপের পেজে ছবি পোস্ট হতেই তৎপর হয়ে ওঠেন ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’-র সদস্যরা। গ্রুপের অন্যতম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও বাস নিয়ে আগ্রহী অনিকেত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘কী করব বুঝতে না পেরে সরাসরি পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীকে ফোন করি। উনি ফোন ধরে পুরো বিষয়টা শোনেন এবং বাসটিকে বাঁচানোর আশ্বাস দেন।’ মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওই বাস যে ততক্ষণে কাটার জন্য নিলামে উঠে গিয়েছিল, সেটা তিনি জানতেন না।

    ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’-র পক্ষ থেকে সৌভিক মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ২০০৫ থেকে এই ডাবল-ডেকারগুলো বাতিল হতে শুরু হয়। ২০১৬ নাগাদ শেষ এই বাসটার কিছু মেরামতি এবং কাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়। যাত্রী পরিবহণ থেকে অবসরে যাওয়ার পরে বাসটি ইকো পার্কে জয় রাইডের জন্য ব্যবহার হতো। অনিকেত বলছেন, ‘বাসটিকে স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে খবর পেয়ে ফের আমরা মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। এ বার তিনি নিজে নির্দেশ দেন বাসটি বাঁচানোর জন্য। তিনি উদ্যোগ না নিলে বাসটি বাঁচানো যেত না।’

    পরিবহণমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারি উদ্যোগে একটি পরিবহণ জাদুঘর তৈরি হবে, সেই জাদুঘরে এই বাসটি জায়গা পাবে। রাজ্য পরিবহণ দপ্তরের আধিকারিকরা জানিয়েছেন, রবিবার বাসটিকে স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড থেকে বের করে পাইকপাড়া ডিপোয় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাদুঘরে যাওয়ার আগে বাসটি আপাতত সেখানেই থাকবে।

    ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’ রাজ্য পরিবহণ দপ্তর এবং বিশেষ করে পরিবহণমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। ‘কলকাতার যীশু’ কবিতায় উল্লেখ করা ওই ‘বাঘ-মার্কা ডবল-ডেকার’-এর শেষ প্রতিনিধিকে রক্ষা করার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে তারা। ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়া পেশেন্ট সুস্থ হয়েছেন, এমন নজির থাকলেও স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে চলে যাওয়া বাস ‘বেঁচে’ বেরিয়েছে, এমন নজির তো বিশেষ নেই।
  • Link to this news (এই সময়)