• গ্লোবাল ট্রেন্ডের উল্টোপথে হাঁটছে কলকাতা
    এই সময় | ০৭ অক্টোবর ২০২৪
  • দেবাশিস দাশগুপ্ত

    সামনেই ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজ়। এখনই ‘ভারতবধ’ নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছেন অজি় পেসার প্যাট কামিন্স, স্পিনার নাথান লিও। কিন্তু এই মুহূর্তে একজন অস্ট্রেলিয়ান যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে কলকাতা থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি ক্রুদ্ধ। তিনি রবার্তো ডি আন্দ্রে, মেলবোর্নের প্রাক্তন এই ট্রাম কন্ডাক্টরের হাত ধরেই গত শতকের নয়ের দশকে মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল কলকাতার ট্রাম।১৯৯৪-তে প্রথম বার কলকাতায় তিনি পা রেখেছিলেন একেবারে নিখাদ ট্রামপ্রেমী হিসেবে। ঘুরেছেন নোনাপুকুর, বেলগাছিয়া, গড়িয়াহাট, টালিগঞ্জ সমেত ট্রাম টার্মিনাসগুলোয়। তাঁর সপ্রতিভতা, সহজাত ব্যক্তিত্ব, ভাঙা বাংলায় বলা কথায় মুগ্ধ হন এখানকার ট্রামকর্মীরা। কলকাতার মানুষকে আপন করে নেন রবার্তো। এর পর ১৯৯৬ সাল থেকে ট্রামপ্রেমী দেবাশিস ভট্টাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন মেলবোর্ন-কলকাতা ফ্রেন্ডশিপ ট্রামযাত্রা। ২০১৬-তে সেই ট্রামযাত্রার ২০ বছর পূর্তিতে বড় অনুষ্ঠানও হয় কলকাতায়। তারও মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সেই রবার্তো।

    কলকাতা থেকে ট্রাম তুলে দেওয়া হচ্ছে শুনে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের বাসিন্দা রবার্তো রীতিমতো হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডের একেবারে উল্টোপথে হাঁটছে কলকাতা। বিশ্বের সব সিটি আবার ট্রাম ফিরিয়ে আনছে লাইট রেল হিসেবে। এর লক্ষ্যই হচ্ছে ভিড়ের চাপ কমানো, দূষণমুক্তি এবং কার্বন নিঃসরণ দূর করা।’ যোগ করেন, ‘এই সিদ্ধান্ত মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে পড়ার লক্ষণ। আজকের দুনিয়ায় ডি-কার্বনাইজ়িং ট্রান্সপোর্ট হিসেবে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিরুদ্ধে বড় হাতিয়ার ট্রাম।’

    ২০২২-এও কলকাতার ট্রামযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন রবার্তো। ট্রামের পা-দানিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছেন, ‘কলকাতা ভালোবাসি, ট্রাম ভালোবাসি’। আবার কখনও চেঁচিয়ে জনতার উদ্দেশে বলেছেন, ‘বেলগাছিয়া যাবে, চলে আসুন’। ট্রামযাত্রীদের হাতে তুলে দিয়েছেন মেলবোর্ন থেকে আনা কনি (কন্ডাক্টর) কার্ড। তাতে কলকাতা-মেলবোর্নের ট্রামের ছবি। কোনও কার্ডে ক্যাঙারু-বাঘ, কোনও কার্ডে দুই দেশের পাখি। বাৎসরিক সেই ট্রামযাত্রায় গানও বাঁধা হয়েছিল—

    ‘দ্য স্কাই ইজ় নো মোর ব্লু

    স্মোক গিভস ইট দ্য গ্রে হিউ

    পলিউশন ইনক্রিজে়স, হিমালয়ান ডিক্রিজে়স

    ডু ইউ নো অর ইউ ডোন্ট?’

    শহর থেকে ট্রাম উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? রাজ্যের যুক্তি, কলকাতায় জনসংখ্যা ও গাড়ির সংখ্যা অনেকে বেড়েছে গত দু’দশকে, অথচ যান চলাচলের রাস্তা বাড়েনি। এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই নয় ধীরগতির ট্রাম। ট্রামের জন্য শহরে বাড়ছে যানজট। আবার ট্রাম লাইনে বিশেষ করে মোটরবাইক-স্কুটারের চাকা পিছলে দুর্ঘটনাও ঘটছে। সেই কারণেই ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে একমত হতে পারছেন না রবার্তো। তাঁর কথায়, ‘সেইং নো টু ট্রাম, ইউ আর কিলিং ইয়োরসেল্ফ। সঠিক ম্যানেজমেন্টে ট্রাম চালানো হলে এসব সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দ্রুতগতির ট্রাম চালানোর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলছেন, ‘এই কারণেই বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও নতুন করে ফিরিয়ে আনছে ট্রাম।’

    কলকাতা নিয়ে স্মৃতিকাতর রবার্তোর কথায় বার বার ফিরে আসে এ শহরে তাঁর প্রথম পা রাখার দিনটা। বলছেন, ‘৯৪ সালে প্রথম যে বার কলকাতায় এলাম, ধর্মতলায় এক সকালে ডিং ডিং শব্দ শুনে চমকে উঠেছিলাম। একেবারে আমার মেলবোর্নের শব্দ যেন কানে বাজল। ভালোবেসে ফেললাম এই শহর আর তার ট্রামকে।’

    রবার্তোর সঙ্গে কলকাতায় একসঙ্গে ট্রাম বাঁচানোর আন্দোলনে সামিল হয়েছেন লেকটাউনের সাগ্নিক গুপ্ত। তিনি বলেন, ‘ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সেই বাম আমলে ৯৪-৯৫ সালেই হয়েছিল। তখন পরিবহণমন্ত্রী ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। সেই পরিস্থিতিতে রবার্তোর প্রাণবন্ত ভূমিকা পরিবেশ পুরো পাল্টে দিয়েছিল। সুদূর দক্ষিণ গোলার্ধের একটি দেশ থেকে এসে তাঁর ট্রাম বাঁচানোর আন্দোলন অবশ্য বুঝতে পেরেছিল তৎকালীন সরকার। তখন ৪০টি রুটে ট্রাম চলত।’

    ১৯৩০ সাল থেকে ট্রামের যাবতীয় টিকিট, বিজ্ঞপ্তি সংগ্রহে রয়েছে গড়িয়ার বাসিন্দা শৌভিক রায়ের। লাল কালিতে লেখা বিতর্কিত সেই এক পয়সা ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিজ্ঞপ্তিও রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। শৌভিকের কথায়, ‘রবার্তোর মতো মানুষ দুর্লভ। তাঁর জন্য কলকাতার গর্ববোধ করা উচিত।’ যোগ করেন, ‘এই সরকার অটো চালাতে চায়। ট্রামের চেয়ে তাদের কাছে অটো বেশি কার্যকর।’

    কলকাতায় কি আর ট্রামযাত্রা হবে? আর কি কখনও কলকাতার মাটিতে পা রাখবেন রবার্তো? গাইবেন কি---

    ‘ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডাই টুগেদার লেটস ফাইট।’

    নাকি পাকাপাকি বিচ্ছেদই ঘটে যাবে মেলবোর্ন-কলকাতা মৈত্রীর? সময়ই এর উত্তর দেবে।
  • Link to this news (এই সময়)