• ‘‌বহুরূপী’‌ একটা অভিজ্ঞতা, সেখানে রং আছে, রং ধুয়ে ফেলাও আছে
    আজকাল | ০৭ অক্টোবর ২০২৪
  • প্রচেত গুপ্ত

    অন্য কথায় যাওয়ার আগে বলে রাখি, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা রায়ের ছবি ‘‌বহুরূপী’‌ দেখা একটা অভিজ্ঞতা। বাংলা সিনেমায় এমন অভিজ্ঞতার সুযোগ ইদানীং বড় একটা আসে না। যাঁরা মনে করেন সিনেমা শুধু সিটে এলিয়ে বসে দেখার বিষয় নয়, মাঝেমধ্যে পিঠ সোজা হয়ে যাওয়া উচিত, যাঁরা মনে করেন, সিনেমা শুধু নিমীলিত চক্ষে, প্রেম–প্রেম বক্ষে, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নয়, মাঝেমধ্যে চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়া দরকার, যাঁরা মনে করেন সিনেমা–‌থিয়েটার শুধু তন্ত্রমন্ত্রের সুড়সুড়ি নয়, মাথায় ঠেকিয়ে রাখা রিভলভার নয়, সিনেমাও মাঝেমধ্যে জীবন ও সমাজের গভীর সত্য দাবি করে, যাঁরা মনে করেন, সিনেমা শুধু ‘‌ইন্টেলেকচুয়াল’ হওয়ার ভান নয়, চলচ্চিত্র–উৎসবে ছুটে বেড়ানো নয়, মনোরঞ্জনেরও, যাঁরা মনে করেন সিনেমা শুধু সিনেমাহলেই শেষ হওয়ার নয়, হল থেকে বেরোনোর পরও বেশ কিছুদিন ভাবনায়, তর্ক–বিতর্কে থাকার, তঁারা ‘‌বহুরূপী’‌ ছবিটি দেখতে পারেন। আবার যাঁরা মনে করেন, ধুস্‌‌, এত সব বুঝি না, পুজোয় একদিন ‘‌বই’‌ দেখে, বাইরে খেয়ে, ত্রিধারা, বোসপুকুর বা টালা প্রত্যয়ে ঠাকুরকে নম করে বাড়ি ফিরব, তাঁরাও দেখতে পারেন। ভাল না মন্দ, সেটা পরের কথা। আগে দেখতে হবে, তারপর কথা। বাংলা সিনেমা নিয়ে ‘‌কথা’‌ আজকাল কমে গিয়েছে। কমে গিয়েছে হলের দর্শকও। দুটোই চাই। দর্শক এবং ভাবনা। দর্শক পেতে গিয়ে ভাবতে ভুলে যাওয়া বা ভাবতে গিয়ে দর্শক ভুলে যাওয়া যে কী বিপদের, তা নিশ্চয় অনেকেই টের পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন।

    এবার বলি, আমি একজন অতি সামান্য লেখক। সিনেমা, থিয়েটার, গান নিয়ে আলোচনা করার অধিকার আমার নেই। আমি যখন ‘‌মহানন্দা’‌, ‘‌হুব্বা’‌র মতো ছবি নিয়ে লিখেছি, তখন একথা বলেছিলাম। এর জন্য অন্তত কুড়িটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র–উৎসব কেচে, ধুয়ে, ছাদে শুকোতে দেওয়ার অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। ইরাক, ইরান, লেবানন, তানজানিয়া–সহ একচল্লিশটি দেশের পরিচালকের নাম ঠোঁটের গোড়ায় রাখতে হবে। আমার এসব কিছুই নেই, তাই সিনেমা নিয়ে আলোচনা অনধিকারচর্চা। ঠিকই। কিন্তু একজন সাধারণ সিনেমাপ্রেমী হিসেবে এটুকু তো চাইতে পারি, ভাল ছবি হোক। সুস্থ বাংলা সিনেমা দেখার জন্য হল ভরে যাক‌। সে অধিকার‌ তো আমার আছে।‌ নাকি সে চাওয়াও অন্যায়? ‌

    সিনেমায় শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা রায় বছরের পর বছর ধরে এই কাজটি করে চলেছেন। হলে দর্শক আনছেন। ‘‌বউ সিরিজ’, ‘‌বর সিরিজ’‌, ‘‌বাবা সিরিজ’‌ ছাড়াই আনছেন। কত রকমের বিষয় নিয়ে যে কাজ করেছেন!‌ বৈচিত্র ভরা পথে এই দীর্ঘ সাফল্য সহজ কথা নয়। বাঙালি দর্শক তাঁদের বিগত বহু ছবিতে যেমন হেসেছেন, কেঁদেছেনও। ওহ্‌, কান্না বিষয়টি তো আবার ‘‌ইন্টেলেকচুয়াল’‌ নয়। চার্লি চ্যাপলিনের কাজ দেখে চোখ ভিজে গেলে ঠিক আছে, সত্যজিতের ‘‌পথের পাঁচালী’‌ দেখে কাঁদলে তুমি মননশীল, মতি নন্দীর ‘‌কোনি’‌ পড়ে কাঁদা যেতেই পারে, ‌‘‌লাপাতা লেডিস‌’‌ দেখে চোখ মুছলে কেয়া বাত, শুধু ‘‌বহুরূপী’‌ দেখতে বসে রুমাল বের করতে হলেই সমস্যা?‌ আমি মানি না। দর্শকরাও মানবে না। তার হাসতে ইচ্ছে করলে হাসবে, কাঁদাতে ইচ্ছে করলে কঁাদবে। ইচ্ছেটাই আসল। এই ‘‌ইচ্ছে’‌ তৈরির জাদুকাঠিটি চেনেন দুই পরিচালক।

    একেবারে অন্য ভাবনার ছবি ‘‌‌বহুরূপী’‌। ‘‌ব্ল্যাক স্টোরি’‌ সম্ভবত একেই বলে।‌ অন্ধকারের গল্প, কিন্তু আলোয় মাখামাখি। শুধু আলোয় নয়, রঙেও। বহুরূপীদের সাজের রঙে। লোকশিল্পী বহুরূপী, মানুষ বহুরূপী, বিশ্বাস বহুরূপী। গাড়ি ধাওয়া করার টান টান দৃশ্য দিয়ে শুরু করে এই থ্রিলার কাহিনি পৌঁছে যায় সমাজের এক গভীর সত্যের ক্লাইম্যাক্সে। মূলত এক ডাকাত আর এক পুলিশের গল্প। কখনও ডাকাতকে ভাল লাগে, কখনও পুলিশকে। ভাল–মন্দ, ন্যায়–অন্যায়, সাদা–কালোর ধারণা উল্টেপাল্টে যায়। অথচ মজার বিষয়, দু’‌জনেই হিরো। কাহিনি যেমন উত্তেজনার, তেমন স্নিগ্ধ। যেমন চমকপ্রদ, তেমন অবশ্যম্ভাবী। যেমন ক্রূর, তেমন ভালবাসার। এত বঁাক যে, নিশ্চিন্ত থাকার উপায় নেই। গোটা গল্পটাই যথোপযুক্ত, ‘‌সিনেমা’‌সুলভ বিস্ময়ে ভরা। একটি লাইনও আগাম বলে দেওয়া অন্যায় হবে।

    অতি পরিশ্রমে, অতি যত্নে দুই পরিচালক ছবিটি তৈরি করেছেন। মারপিট থেকে প্রেম, শোক থেকে সুখ, প্রাপ্তি থেকে বিপন্নতা— কোথাও খামতি রাখেননি। ছবির বহু বিষয়ই উল্লেখ করা যায়। দুটির কথা বলি। ছ্যাঁচড়াপুর গ্রামের বহুরূপীর দল এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (বিক্রম)‌–এর অভিনয়। বহুরূপীদের সঙ্গে বিক্রমের প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটি ভয়ঙ্কর সুন্দর। যেন বড় কোনও শিল্পী ক্যানভাসে এঁকেছেন। আর তাঁদের মাঝখান দিয়ে বিক্রমের হেঁটে যাওয়া সত্যের উন্মোচন। মানুষের বহুরূপ দর্শনের সত্য। বহুরূপীরা যে যেখানে অভিনয় করেছেন, গেয়েছেন, নেচেছেন, ছবির সম্পদ বাড়িয়েছেন। সেসব কথা নিশ্চয় যোগ্য আলোচকরা নাম ধরে ধরে বলবেন। শিবপ্রসাদবাবু এক নতুন আঙ্গিকের চরিত্রে অভিনয় করলেন। নতুন সাজে, নতুন ম্যানারিজমে। কঠিন চরিত্র। মাত্রা রক্ষা করা ছিল কঠিন চ্যালেঞ্জ। কে জানত, ব্ল্যাক কমেডিতেও তিনি এতটা দড়?‌ চোখ ফেরাতে দেননি। গ্রামে বহুরূপীদের সঙ্গে নাচ–গানের আসরটি শুধু দৃশ্য হিসেবে চমৎকার নয়, সভ্যতার প্রতি প্রান্তিক শিল্পের কশাঘাতও বটে। অথচ কত সহজ, কত প্রাণবন্ত ভাবে ক্যামেরাবন্দি!‌ বহুদিন ধরেই এই ছবির দুই পরিচালক বিনোদন এবং চেতনাকে একসঙ্গে নিয়ে চলায় অভ্যস্ত।

    ‘‌বহুরূপী’র‌ সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ। পর্দার সামনে বসে লম্বা সময় কীভাবে কেটে গেল, উইন্ডোজ প্রোডাকশনের টিম বুঝতে দেয়নি।

    সেটাই জীবন, যা চলে বহু রূপে। যেখানে রং আছে, আবার রং ধুয়ে ফেলাও আছে। দুই নিয়েই চলতে হয়। রঙিন এবং বিবর্ণ জীবন। ‘‌বহুরূপী’ তা–ই। এই দুই পরিচালক তাঁদের ছবিতেই কিছু না কিছু বলতে চান। সে কথা যে শুনতে পায়, সে পায়। আর যে পায় না, তারও কিছু ক্ষতি হয় না। এখানে তার অন্যথা তো হয়ইনি, বরং সাহসী ভাবে হয়েছে। নইলে কাহিনির শেষে.‌.‌.‌ না থাক‌, বলে দেওয়া ঠিক হবে না।
  • Link to this news (আজকাল)