• ‘স্মৃতিকে ধরে রাখতে খানিকটা পোড়া মাটি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি!’
    এই সময় | ০৮ অক্টোবর ২০২৪
  • পিনাকী চক্রবর্তী ■ আলিপুরদুয়ার

    এই তো তিন মাস আগেও একঘর সবুজের মধ্যে স্বমহিমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল সে। যার আকর্ষণে আম-আদমি থেকে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা বার বার ছুটে আসতেন। আজ সে ঠাঁই নিয়েছে কালের গর্ভে!গত ১৮ জুন রাতে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের হেরিটেজ তকমা পাওয়া কাঠের হলং বনবাংলো। বন্যপ্রাণীদের প্রজনন মরসুম হওয়ায় তখন অবশ্য বন্ধ ছিল জঙ্গল। টানা তিন মাস বন্ধ থাকার পরে ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ফের খুলেছে জাতীয় উদ্যান। পর্যটকদের একাংশ এখন পুড়ে যাওয়া হলং বনবাংলোই দেখতে আসছেন। বাংলো বলতে কিছুই নেই সেখানে। স্রেফ পোড়া জমি। আর ডাইনিং হলের স্টাকচারের খানিকটা। তা দেখেই স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছেন তাঁরা।

    পুড়ে যাওয়া বাংলো চত্বরের পোড়া মাটির মধ্যেই খুঁজে ফিরছেন অসাধারণ সেই কাঠের স্থাপত্যকে। জলদাপাড়ায় বন্যপ্রাণীদের আনাগোনা আগে যেমনটা ছিল, এখনও ঠিক একই রকম রয়েছে। নেই শুধু প্রিয় বাংলোটাই। সে শূন্যতায় বার বার নস্টালজিক হয়ে পড়ছেন সবাই। ওই চত্বরেই দেখা মিলল বাংলাদেশের যশোহরের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পরিতোষ দাসের।

    বললেন, ‘মনের একটা সাধ ছিল। রাত্রিবাসের সুযোগ না পেলেও অন্তত হলং বাংলো চাক্ষুষ করব ভেবেছিলাম। ছবি তো অনেক দেখেছি। কিন্তু এখানে এসে ওই ছবি কল্পনা করে মনটা বিষাদে ভরে উঠেছে। আর কি কখনও সেই সুযোগ আসবে এ জীবনে? আক্ষেপটা নিয়েই ফিরতে হবে দেশে।’

    কেউ কেউ হয়তো রাতও কাটিয়েছেন ওই বনবাংলোয়। তাঁরাও এসে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন। আসানসোলের পিয়াল সাহা বসেছিলেন হলং গ্লেডের (জঙ্গলের মাঝে থাকা খোলা তৃণভূমি) ধারে সিমেন্টের বেঞ্চে।

    বললেন, ‘নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না। জলদাপাড়া আছে, থাকবে। কিন্তু বাংলোটা নেই, দেখামাত্রই মনটা কেমন হু হু করে উঠছে। ২০১১ সালেও সপরিবারে রাত কাটিয়েছিলাম তিন নম্বর ঘরে। তক্ষকের অদ্ভুত ডাক আর ঝিঁঝি পোকা! মন কেমন করা! সব কিছুই হারিয়ে গেল। জানেন হলং-এর স্মৃতিকে ধরে রাখতে খানিকটা পোড়া মাটি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।’

    পুড়ে যাওয়ার পরে প্রাথমিক অবস্থায় হলং বনবাংলো চত্বরে ঢোকার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল বন দপ্তর। এখন অবশ্য পর্যটকদের অনুরোধে সে সব প্রত্যাহার করা হয়েছে। পর্যটকরা এখন বিনা বাধাতেই সেই পুড়ে যাওয়া বাংলোর খালি জমিতেই ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন।

    জলন্ধরের আশা সিধু বলেন, ‘১৯৯৮ সালে বাবা ও মায়ের সঙ্গে এসেছিলাম। অ্যালবামে সে ছবি এখনও আছে। আজ জায়গাটিতে এসে চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। আমার সন্তানদের নিয়ে এলাম বটে। তবে ওরা দেখতে পেল না হলং বনবাংলোকে।’

    জলদাপাড়া বনবিভাগের ডিএফও প্রবীণ কাসোয়ান বলেন, ‘হলং বনবাংলোর সামনের গ্লেডটি বন্যপ্রাণীদের আনাগোনার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ফলে ওখানে পর্যটকদের যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও রকম বিধিনিষেধ রাখা হয়নি। সেই সুযোগে অনেকেই হলং বনবাংলোর পুড়ে যাওয়া চত্বরে আসছেন। আমরা কোনও বাধা দিচ্ছি না।’

    ইস্টার্ন ডুয়ার্স ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘স্থানের অভাবেই বলুন অথবা খরচের বহরের কারণে অনেকেই হলং বনবাংলোতে থাকার সুযোগ পাননি। কিন্তু বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে সঙ্গে বহু পর্যটক শুধু ওই বাংলোকে চাক্ষুষ করতেই ছুটে আসতেন। এখন সেখানে এক গভীর শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যা কোনও ভাবেই মেটার নয়।’
  • Link to this news (এই সময়)