• নতুন জামা কিনে দেবে বলেছিল বাবা দেহের সামনে দাঁড়িয়ে কান্না রাখির
    বর্তমান | ০৮ অক্টোবর ২০২৪
  • সৌম্যদীপ ঘোষ, লোকপুর: ‘বাবা বলেছিল, পুজোর আগে বেতন হয়ে যাবে। তারপর দাদাকে, আমাকে নতুন জামা কিনে দেবে। সকালে ঘরে খেয়ে কাজে এল। কিন্তু আর কোনওদিন বাবা আমায় জামা কিনে দেবে না!’ হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এমনই বলছিল কয়লা খাদানে বিষ্ফোরণে মৃত যুদ্ধ মারান্ডির মেয়ে রাখি। গলা জড়িয়ে আসছে তার। বাড়ির লোকেরা স্বান্তনা দিয়েও তার কান্না থামাতে পারছেন না। রাখি যেন আরও পাঁচজন মৃত শ্রমিকের অসহায় পরিবারের প্রতিনিধি। যাঁদের এবার পুজোর আনন্দটাই কেড়ে নিয়েছে অভিশপ্ত ডিটোনেটর বোঝাই গাড়ি। 


    মৃত যুদ্ধ মারান্ডির বাড়ি স্থানীয় দেবগঞ্জ গ্রামে। বাড়িতে স্ত্রী ছাড়াও দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। রাখি নবম শ্রেণিতে পড়ে। এদিন দুপুর ১২টা নাগাদ তাকে সকলে মিলে ধরে কয়লা খাদানের নীচে নামান। বাবার ছিন্নভিন্ন দেহের কাছে পৌঁছনর কয়েকফুট আগেই রাখি আর হাঁটতেই পারছিল না। সেখানেই মাটিতে বসে পড়ে। আশপাশের অন্যান্য মহিলারাও স্বজন হারানোর যন্ত্রণায় কাঁদতে শুরু করেছেন। সেই পরিবেশকে আর ভারি করে দিল রাখি। আর্তচিৎকার করে বলে উঠল, ‘পুজোয় নতুন জামা কিনে দেবে বলেছিল বাবা। আমাদের আর কারও নতুন জামা পরা হল না।’ 


    খাদানে সাধারণত ১০ তারিখে বেতন হয়। সেই হিসেব ধরলে বাকি তিনদিন পর বেতন হওয়ার কথা। রাখি কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘বেতন হলেই বাবা আমাদের নিয়ে কেনাকাটা করতে যাবে বলেছিল।’ বলেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে সে। তাকে কে তখন সামলাবে? তার আশপাশে সব স্বজনহারাদের আর্তনাদ। রাখির পাশে বসে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছিলেন মৃত মঙ্গল মারান্ডির স্ত্রী বুড়ি মারান্ডি। আলুথালু চুল। বেবাক দৃষ্টি। কোনওরকমে তিনি বলছিলেন, ‘সেই সকালে ঘরে খেয়ে বেরোল। তারপর শুনছি এই ঘটনা।’ একটু দূরে ঠিক একইভাবে কাঁদছিলেন পশ্চিম বর্ধমানের মাধবপুরের মঙ্গল সিং। তরতাজা জওয়ান ছেলে অমিত সিং বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন। দীর্ঘ ৭ বছর ধরে এই কোম্পানির প্লাস্টিক ইনচার্জ পদে কাজ করে আসছেন। খাদানের পাশে কোম্পানির কোয়ার্টারে থাকতেন। এদিন সকালে ফোন মারফৎ জানতে পারেন এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘এই কোম্পানিতে ও ৭ বছর কাজ করছে। এমন পরিণতি হবে ভাবতেই পারছি না। বিস্ফোরক টোপি আর দ্রাহ্য পদার্থ (যাকে স্থানীয় ভাষায় কলা বলা হয়) সবসময় আলাদা থাকে। একসঙ্গে রাখা যায় না। কিন্তু এখানে এসে দেখছি, দু’টো জিনিসই একসঙ্গে ছিল। ওই গাড়িতে কিছু গাফিলতি নিশ্চয় ছিল। না হলে এত বড় বিষ্ফোরণ ঘটত না। আমার ছেলে এসব কাজের সুপারভাইজার ছিল। কোথাও একটা গাফিলতি ছিল। তাই হয়তো তাঁকে হারালাম।’ এই কথা বলতে বলতেই চোখের জল গড়িয়ে পড়ল মঙ্গলবাবুর। এদিন কয়লা খাদানের চারদিকে শুধু কান্নার রোল। মাংসের টুকরো চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে।     স্বজনহারারা। নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)