চার্জশিটে শুধু সঞ্জয়ই, ষড়যন্ত্রে কারা, উঠে আসবে আগামী দিনে?
এই সময় | ০৮ অক্টোবর ২০২৪
এই সময়: আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনে কি শুধু কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়-ই জড়িত, নাকি আরও কেউ— ৯ অগস্টের ঘটনার পর থেকেই উঠছিল এই প্রশ্ন। ওই নৃশংস ঘটনার ৫৮ দিনের মাথায় শিয়ালদহ আদালতে সিবিআই যে প্রথম চার্জশিট জমা দিল, তাতে আপাতত একা সঞ্জয়কেই এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধেই ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ (ধর্ষণ), ৬৬ (ধর্ষণ ও খুন অথবা এমন অত্যাচার করা যাতে নির্যাতিতা ভেজিটেটিভ পর্যায়ে পৌঁছে যায়) এবং ১০৩ (১) (খুন) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।সোমবার দুপুরে শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অরিজিৎ মণ্ডলের এজলাসে ওই চার্জশিট জমা পড়েছে। সূত্রের খবর, বিচারক তা গ্রহণ করেছেন। সিবিআই এই মামলায় প্রথম চার্জশিট জমা দিলেও খুনের মোটিভ কী, এর নেপথ্যে আরও কারও ষড়যন্ত্র ছিল কি না, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের ষড়যন্ত্রে আর কারা ছিল— সে সব নিয়ে তদন্ত চলবে বলেই তদন্তকারী এজেন্সির তরফে আদালতে জানানো হয়েছে।
অর্থাৎ, এই ধর্ষণ-খুনের পিছনে আরও অনেকের যোগ থাকা নিয়ে নির্যাতিতার পরিবার বা আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা প্রথম থেকে যে অভিযোগ করে আসছেন, সে ব্যাপারে আগামী দিনে আরও তথ্য উঠে আসতে পারে বলে সিবিআই সূত্রের দাবি। কলকাতা হাইকোর্ট গত ১৩ অগস্ট এই মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার আগে লালবাজারের সিট এই ঘটনার তদন্ত করছিল। তাদের হাতেই গ্রেপ্তার হয় সঞ্জয় রায়।
কলকাতা পুলিশ সূত্রের দাবি ছিল, ধর্ষণ-খুনে ওই একজনই জড়িত। সিবিআইয়ের প্রথম চার্জশিটে সেই ইঙ্গিতই মেলায় রাজ্যসভায় তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ কুণাল ঘোষ বলেন, ‘কলকাতা পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মূল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাদের তদন্ত যে ঠিক পথেই এগোচ্ছিল, সিবিআইয়ের চার্জশিট সেই যুক্তিকেই মান্যতা দিল। আমাদের প্রশ্ন, তা হলে চার্জশিট দিতে এতটা সময় কেন লাগল?’
সিবিআই সূত্রে খবর, ফরেন্সিক পরীক্ষার রিপোর্ট এবং এ যাবৎ উঠে আসা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রথম চার্জশিটে আপাতত অভিযুক্ত হিসেবে সন্দীপের নামের উল্লেখ রয়েছে। এই মামলাতেই আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। প্রথম চার্জশিটে অভিযুক্ত হিসেবে দু’জনের নাম উল্লেখ না-থাকলেও, ধর্ষণ-খুনের ঘটনার সূত্র ধরে সন্দীপ-অভিজিতের ভূমিকা ওই চার্জশিটে তুলে ধরা হয়েছে।
এই দু’জন যে তথ্যপ্রমাণ লোপাটে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র করেছেন, সে দাবি আগেই আদালতে করেছিল সিবিআই। আগামী দিনে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে এই দু’জনের এবং আরও কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হবে বলে সূত্রের খবর। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম চার্জশিটে মোট ১২৮ জন সাক্ষীর বয়ান নথিভুক্ত করা হয়েছে।
সঞ্জয় গ্রেপ্তার হলেও তাঁর বক্তব্যে বেশকিছু অসঙ্গতি থাকায়, নার্কো অ্যানালিসিস টেস্ট করতে চেয়ে আবেদন করেছিল সিবিআই। আদালতে তাতে সম্মতি দেয়নি সঞ্জয়। ঘটনার আগে-পরে আরজি কর হাসপাতাল ও টালা থানার সিসিটিভি ফুটেজ, সন্দীপ-অভিজিতের মোবাইলের ডিজিটাল নথি খতিয়ে দেখে তাঁদেরও যথাক্রমে নার্কো ও পলিগ্রাফ টেস্ট করাতে চেয়েছেন তদন্তকারীরা। তা-ও চার্জশিট পেশের আগে সম্ভব হয়নি।
তা হলে কি তদন্ত এখনও অসম্পূর্ণ?
সিবিআই সূত্রে খবর, এই ঘটনায় নানা পরত রয়েছে। এখনও পর্যন্ত যে সব তথ্যপ্রমাণ যা মিলেছে, তার ভিত্তিতে ধর্ষণ-খুনে সঞ্জয়ই একমাত্র অভিযুক্ত। কিন্তু এর নেপথ্যে আরও কেউ আছে কি না বা বড় কোনও ষড়যন্ত্রের হয়েছিল কি না, তা তদন্তের পরবর্তী ধাপে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, গত ৮ থেকে ১০ অগস্ট সময়সূচি ধরে আরজি কর হাসপাতালে কখন, কী ঘটেছিল— তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে চার্জশিটে। ওই সময়ের মধ্যে সঞ্জয়ের গতিবিধিও তার মধ্যে রয়েছে। সঞ্জয় মদ্যপ অবস্থায় ওই তরুণী চিকিৎসকের উপর চড়াও হয়ে তাঁকে ধর্ষণ করে বলেই দাবি তদন্তকারীদের। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট উল্লেখ করে চার্জশিটে দাবি করা হয়েছে, তরুণীর মাথা, গাল, বাঁ হাত, বাঁ কাঁধ, ঠোঁট, নাক, ডান চোয়াল, চিবুক, গলা, বাঁ হাঁটু, গোড়ালি এবং যৌনাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন মিলেছে। তাঁর ফুসফুসে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। চিকিৎসক পড়ুয়াকে শ্বাসরোধ করে ‘খুন’ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ রয়েছে চার্জশিটে। যৌনাঙ্গে জোর করে পেনিট্রেশন হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সিবিআই ঘটনার তদন্ত শুরুর সময়ে ন্যায় সংহিতার ৬৪ ও ১০৩(১) ধারায় এফআইআর করেছিল। তবে চার্জশিটে ৬৬ নম্বর ধারাটি যুক্ত করা হয়েছে। তদন্তকারীদের দাবি, ধর্ষণে বাধা দেওয়ায় তরুণীর উপর শারীরিক অত্যাচার চালায় অভিযুক্ত সঞ্জয়। তাতে তরুণী প্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়লে ওই অবস্থাতেও যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছিল।
সূত্রের খবর, ধর্ষণ-খুনের ঘটনাপরম্পরার পাশাপাশি নির্যাতিতার দেহ উদ্ধারের ১৪ ঘণ্টা পর কেন এফআইআর করা হয়েছিল, এখনও পর্যন্ত কোথায় কোথায় গাফিলতি পাওয়া গিয়েছে, তা-ও জানানো হয়েছে ওই চার্জশিটে।
আরজি করের ঘটনার পরে নির্যাতিতার বাবা-মা এবং জুনিয়র ডাক্তারদের অনেকেই দাবি করেছিলেন— ইনকোয়েস্ট এবং পিএম রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, আধঘণ্টা সময়ের মধ্যে একজন মদ্যপ অভিযুক্তের পক্ষে গোটা অপরাধ ঘটানো সম্ভব নয়। এ দিন নির্যাতিতার বাবা-মার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা মন্তব্য করেননি। তবে আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসক দেবাশিস হালদারের বক্তব্য, ‘চার্জশিটের কপি আমরা এখনও হাতে পাইনি। আমাদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছি।’
সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সজল বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘সঞ্জয় রায়কে এক মাত্র দোষী হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশার পরিপন্থী। ইনকোয়েস্ট রিপোর্ট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট থেকে যা উঠে এসেছে, তাতে একজনের পক্ষে এমনটা সম্ভব নয়।’ মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের রাজ্য সম্পাদক বিপ্লব চন্দ্রের কথায়, ‘এটা কি নিছক কেন্দ্রীয় সংস্থার অদক্ষতা, নাকি অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে?’