• চোখ ধাঁধানো থিম-মণ্ডপ তৈরি হয় যাঁদের ‘অদক্ষ’ শ্রমের জোরে
    আনন্দবাজার | ০৮ অক্টোবর ২০২৪
  • ঋজু বসু

    অর্ধেক বা একটা আস্ত বছরের পরিশ্রম, সাত দিনের আহ্লাদের পর ভেঙে ফেলতে কেমন লাগে? লোহালক্কড়, কাঠের বাটাম, প্লাস্টার অব প্যারিসের মণ্ড ঘাঁটাঘাঁটি করে শূন্য থেকে কিছু গড়ে তোলা কি বেশি কঠিন? না, ভেঙে ফেলাটা? ভাঙার সময়ে কি শরীর ছেড়ে দেয়? কাজের ভার দুর্বহ হয়ে ওঠে রক্তমাংসের শরীরে? এই প্রশ্নগুলো দুর্গাপুজোর কোনও শ্রমিকের কাছে কে আর জানতে চায়! তত দিনে পাড়ার মাঠে, গলির কোণে ডাঁই হওয়া মণ্ডপের জঞ্জাল দেখতে দেখতে আমরা তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছি।

    কলকাতার পুজোর খ্যাতনামা থিম-শিল্পী সুশান্ত পালের মোবাইল ফোনে একটা ছবি দেখে এ সব মনে হল। অনেক পুরস্কার টানা, হইহুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখা পুজোমণ্ডপ ভাঙার সময়ে অনামা শ্রমিকের পিছন থেকে ছবিটা তুলেছিলেন কেউ। সামনে ধ্বংসস্তূপ। উৎসবের রাতে হয়তো ওখানেই একটা সুদৃশ্য নটরাজ মূর্তি রাখা ছিল। এখন নেই! সেই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে অকিঞ্চিৎকর শ্রমিক কী ভাবছিলেন, জানা নেই! কিন্তু ছবিটা শিল্পী তাঁর মোবাইলে যত্নে রেখেছিলেন। সৃষ্টির শেষে ধ্বংসের অতলে আদিগন্ত শূন্যতার ছবি! দুর্গাপুজোও কি আসলে এমনই শূন্যতার উদ্‌যাপন নয়? হয়তো সে শূন্যতার আড়ালেই পূর্ণের বসত! ভাবতে ভাবতে শিল্পী তাঁর পরের বছরের পুজোর রসদ খুঁজে পেলেন।

    বাঙালির কাছে দুর্গাপুজোর ব্যঞ্জনা এই বোধের আধারেই। রাজ্যের ক্লিশের মোড়কে যা বছর বছর আবিষ্কার করতে হয়। ভাবতে ভাবতেই আর একটি ছবির কথা মনে পড়ল। দুর্গাপুজোর আর এক সফল শিল্পী পার্থ দাশগুপ্ত দেখিয়েছিলেন, মণ্ডপে ১৬ ফুট উঁচু একটা প্ল্যাটফর্মে ফাইবারের লক্ষ্মীঠাকুরকে কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে তোলা হচ্ছে। তুলছেন তিন জন। জহিরুল রঙের মিস্ত্রি। টিকটিকির মতো দেওয়াল বেয়ে উঠতে পারেন। তিনি প্ল্যাটফর্মের উপরে। নীচে মইতে পিছন থেকে মা লক্ষ্মীকে ধরে আছেন কার্তিকদা। তাঁর পিছনে কার্তিকদাকে ধরে কুতুব। তাঁর ঘাড়েই সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব। মতি নন্দীর কাহিনির বহুচর্চিত উপমা মনে পড়ে, ‘ব্যালেন্স, কমল ব্যালেন্স’! দুনিয়া চলছেই ব্যালান্সের উপরে! লক্ষ্মীঠাকুর, কার্তিকদা সবার ব্যালান্স কুতুব ধরে রেখেছেন।

    এই কুতুবকে এ পুজোর আবিষ্কার বলেন পার্থ দাশগুপ্ত। এমন কত হাজারো কুতুব মিশে থাকেন দশকের পর দশক আমাদের বচ্ছরকার পুজো শিল্পকলায়। তাঁরা শিল্পী মোটেই নন। অনেকের কাছেই মনুষ্যপদবাচ্যও নয়। তথাকথিত অদক্ষ শ্রমিক। তাচ্ছিল্য, তুই-তোকারি বা বড়জোর একটু মোলায়েম হুকুমবাচক শব্দের নিশানা। পার্থর মতো গুটিকয়েক শিল্পী এই মিস্ত্রি, জোগাড়েদের বিমা না-করিয়ে কাজ করেন না। ওঁদের জন্য ভদ্রস্থ বাথরুমের ব্যবস্থা করতে উদ্যোক্তাদের উপরে চাপ দেন। কিছু পুজো প্রতিযোগিতাও শ্রমিকদের বিমা, সুরক্ষা-টুরক্ষায় নম্বর দেয়। কিন্তু প্রদীপের নীচের অন্ধকারটা ফিকে হয় না। মাসের পর মাস ঘরছাড়া, মণ্ডপ সাজিয়ে তোলা মানুষগুলোর জীবনধারণের মর্যাদা বা ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে শহুরে পুজো উদ্যোক্তারা ক’জন মাথা ঘামান!

    এই বিপুল শ্রমিক বাহিনীকে অদক্ষ শ্রমিক তকমা দিতে রাজি নন তারকা থিম-শিল্পী ভবতোষ সুতারও! মণ্ডপের সামনে বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। শিল্পীর ড্রয়িং দেখে তা হুবহু ফুটিয়ে তোলার কসরত জানেন ডেকরেটর টিমের ৬-৭ জন সদস্য। তাঁরা নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে যে আরও ৩৫-৪০ জন কর্মী, তাঁদের ভূমিকাটা কী হবে? ভবতোষ মনে করেন, ওই মিস্ত্রিদের কায়িক শ্রমটাকে অদক্ষ শ্রমিকের কাজ বললে অবিচার করা হবে।সমাজ আমাদের শ্রমের বিভাজন করতে শিখিয়েছে। ‘অমুক কাজটা বড়, তমুকটা ছোট’— ভাবনাগুলো গতে বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু স্রেফ ভারবাহী তুচ্ছদের সামান্য ব্যর্থতায় শিল্পীর কত দিনের পরিশ্রম তছনছ হতে পারে!

    জোগাড়ে হয়ে ওঠা সহজ নয়! এক জন দক্ষ জোগাড়ে জানেন কখন কাঠের মিস্ত্রি, লোহার মিস্ত্রি বা ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি, কাকে কোন সরঞ্জামটা সাপ্লাই দিতে হবে। অনেকটা শল্যচিকিৎসার সময়ে ডাক্তারকে ছুরি-কাঁচি এগিয়ে দেওয়ার মতো। ভবতোষ তাঁর পুজোয় নামী ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কাজ করেন। কিন্তু ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস’ যন্ত্রবিশারদ চন্দন মিস্ত্রিকে না-হলে তাঁর চলবে না। তেমন কিছুই না-জেনেও মণ্ডপে কেউ কেউ কেন অপরিহার্য হয়ে ওঠেন? যেমন কুতুব জানেন, সকালে বাঁধা বাঁশের ভারাটা কখন খুলতে হবে। পার্থদার কাজ হয়তো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শিল্পীমানুষের মাথায় কত কী কিলবিল করে! যদি পরে কিছু মনে পড়ল, তখন! কুতুব তাই দরকার ফুরোলেই হুড়োতাড়া করবেন না। শিল্পীর ভাবনাটা সংহত হয়ে ধাতস্থ হতে দেবেন। এটা কোনও রুটিন কাজ নয়, আত্মিক বন্ধন। শুধু শ্রম নয়, পুজো মণ্ডপ তাই শ্রমিকদের ভালবাসারও স্মারক। এই পুজো মণ্ডপেই অনেক কুতুব এক জন প্রায় ‘না-মানুষ’ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সহশিল্পী হয়ে ওঠেন। থিম-স্রষ্টার জন্যও পুজোমণ্ডপ তাঁর ব্যক্তিগত উত্তরণের দরজা খুলে দেয়।

    পুজোর অর্থনীতি নিয়ে নানা কথা হয়। ক্রিয়েটিভ ইকনমি বা সৃষ্টিশীল অর্থনীতির তত্ত্ব সেমিনারের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু পুজোর সমাজনীতির অনেক দিক এখনও অনালোচিত। পোড়খাওয়া থিম-শিল্পী বা ঝানু উদ্যোক্তারা জানেন, এই মানবসম্পদের কখন কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে। ঢালাই বা গাঁথনির কাজে পটু গ্রামবাংলার রাজমিস্ত্রিরা। যাঁরা অনেকেই মুসলিম। রমজান মাসে রোজাভারে ক্লিষ্ট মানুষগুলোকে ছুটি দিতে হবে বা হালকা রাখতে হবে! আবার বিহার থেকে আসা কাঠমিস্ত্রির দলের শ্রাবণ মাসে ছুটি চাই। তখন বাবাধামে জল ঢালতে যেতে হবে যে! এই সবাইকে নিয়ে চলাও কি পুজোর সর্বজনীন হওয়া নয়?মেদিনীপুরের সুদর্শন জানা চাষবাস করেন। শুধু পুজোর ক’মাস আগে তিনি ডেকরেটর সাপ্লায়ার। তালতলার দোকানদার অ্যান্টনি রাতে প্যান্ডেলের সিকিয়োরিটি গার্ড। ঘড়ির কাঁটা ধরে তিনি এলেই মণ্ডপে রাত ন’টা বাজে। রাতভর সব কাজেরই এক দায়িত্বশীল সহযোগী অ্যান্টনিও।

    পুজোমণ্ডপ শুধু নামী শিল্পী, বাঘা কর্মকর্তা-কাম-নেতা বা জাঁকালো স্পনসরের সৃষ্টি নয়। তথাকথিত ছোট কাজের মানুষগুলোর হকদারির আধারও পুজো মণ্ডপ। কাজের রকমফেরও বিচিত্র। শহরের অপাঙ্‌ক্তেয় কিছু এলাকায়, হয়তো বা রেলবস্তির ধারের কুমোরপাড়ায় ‘ডাইস’ দিয়ে ছোট ছোট ঠাকুর গড়েন রূপান্তরকামী ‘না-পুরুষ’এরা! গায়ে-গতরে খাটা রাজমিস্ত্রির কাজের জগতে মেয়েদের দেখা যায়। পুজোমণ্ডপে অবশ্য তাঁরা এখনও তুলনায় অদৃশ্য। তবে এ ছবিটাও ধীরে পাল্টাচ্ছে।

    মণ্ডপের এই সমাজব্যবস্থায় কার কখন কী কাজ ভেবে খাওয়াদাওয়ারও রুটিন ঠিক হয়। মিস্ত্রিরা জানেন, ভারায় উঁচুতে উঠে কাজ অনেক ক্ষণ থাকলে বেশি জল খেতে নেই। ঘন ঘন নীচে নামতে হলে যে মুশকিল! কেউ কেউ মণ্ডপ চত্বরে ধূমপান করবেন না। কাজের জায়গায় কেউ বিড়ির টুকরো ফেললেও অশান্তি করবেন! আবার বাঁশের মাচায় ভ্যাপসা গরমে কাঁঠাল পাকিয়ে কী করে মুড়ি মেখে খেতে হবে তাও কর্মকর্তাদের শেখান গ্রাম থেকে আসা ‘অদক্ষ শ্রমিক’। কিছু ক্ষণের জন্য তৈরি হয় অন্য রকম সামাজিক সমীকরণ।

    তবে ক্যামেরার দিকে পিঠ ফিরিয়ে উৎসব শেষে শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড়ানো শ্রমিককে আমাদের দরকার পড়ে উৎসবের আগে বা পরে। উৎসবের আসল দিনগুলোতে কালিঝুলিমাখা, ক্লান্ত, শীর্ণ অবয়ব অসীম তৎপরতায় ডেকরেটরের কাপড়ের আড়ালে ঢেকে ফেলতে হবে। পুজো দেখে আড়ম্বর না অপব্যয়, শিল্প না গিমিক, মাপতে বসা আমাদের অভিজাত রুচিও কি এই মানুষগুলোর নাগাল পায়? তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি...
  • Link to this news (আনন্দবাজার)