তাঁর জন্মবৃত্তান্ত ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবি সেই ‘দুর্গা’ জন্মেছিলেন মহালয়ার পরের দিন। তারিখটা ছিল ৩ অক্টোবর।তার ঠিক ৪৮ বছর ১ দিনের মাথায় আর এক ইতিহাসের সাক্ষী গোটা দেশ। সেটা মহালয়ার ঠিক দু’দিন পর, গত শুক্রবার, ৪ অক্টোবর। যে দিন দেশে প্রথম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আইভিএফ প্রযুক্তির কল্যাণে এসএসকেএম হাসপাতালে জন্ম নিল আর এক টেস্টটিউব বেবি।
মাঝে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক গুরুত্বে গত শুক্রবারের ঘটনাকে কোনও অংশে ১৯৭৮-এর চেয়ে কম করে দেখতে নারাজ সে দিনের ‘দুর্গা’ কানুপ্রিয়া আগরওয়াল। এসএসকেএমে নিখরচায় আইভিএফ হওয়াকে রাজ্য সরকারের তরফে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ আখ্যা দিচ্ছেন অধুনা মুম্বই প্রবাসী কানু্প্রিয়া। তাঁর সঙ্গে একমত তাঁর বাবা, কলকাতার লর্ড সিনহা রোডের বাসিন্দা প্রভাত আগরওয়ালও। তাঁরা বলছেন, সন্তানহীনতার বেদনা দূর করার চিকিৎসা গরিবের নাগালে আসা সত্যিই যুগান্তকারী ঘটনা।
মুম্বই থেকে ‘এই সময়’কে কানুপ্রিয়া ফোনে বলেন, ‘অসম্ভব ভালো একটা খবর। একেবারে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। মানবতার কাছে এর মূল্য অসীম। কারণ বন্ধ্যত্বের সমস্যা তো আর আর্থিক সঙ্গতি দেখে আসে না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি বা আমার স্বামী সেই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাইনি। কিন্তু আমার মা-বাবা এই সমস্যায় ভুগেছেন। তখন দেবতার মতো তাঁদের জীবনে এসেছিলেন চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সরকারি স্বীকৃতি না পেয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন দুনিয়ার প্রতি অভিমান করে। কিন্তু সেই সরকারই আজ এত বছর পরে বোধ হয় প্রায়শ্চিত্ত করলো এমন একটা পদক্ষেপের মাধ্যমে, যার মধ্য দিয়ে হাসি ফুটবে অসংখ্য সন্তানকামী গরিব দম্পতির মুখে।’
একই সঙ্গে কানুপ্রিয়া মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘একটা জিনিস মাথায় রাখা দরকার। সস্তায় বা বিনামূল্যে পরিষেবাটা মিলছে বলে যেন গুণমানের সঙ্গে কখনও আপস করা না হয়।’ কিন্তু মোটের উপর তিনি খুশি, এসএসকেএমের ভরসায় অনেক ছা-পোষা দম্পতিও আইভিএফ চিকিৎসার সাহায্য নিতে পারবে এ বার। তাঁর কথায়, ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে কোনও সাফল্যই সকলের সাধ্যের মধ্যে আসা বাঞ্চনীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সব ক্ষেত্রে তা হয় না। সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তিও এত দিন তা-ই ছিল। এ বার এসএসকেএম এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কল্যাণে সেটাও সকলের কাছে সাধ্যের মধ্যে চলে এল। যা মানসিক ও সামাজিক ভাবে বন্ধ্যত্বের শিকার বহু দম্পতিকে সমাজের মূল স্রোত থেকে ছিটকে যাওয়ার আশঙ্কাকে অনেকাংশেই নির্মূল করবে।’
ঠিক যে সামাজিক সমস্যায় ১৯৭০-এর দশকে পড়েছিলেন তাঁর বাবা-মা প্রভাত ও বেলা আগরওয়াল। সে সময়ে দেবদূতের মতো তাঁদের জীবনে এসেছিলেন এনআরএসের ফিজ়িয়োলজির শিক্ষক-চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অত্যন্ত অপ্রতুল পরিকাঠামো সত্ত্বেও তাঁর মেধার দৌলতেই ইংল্যান্ডে ১৯৭৮-এর ২৫ জুলাই চিকিৎসক রবার্ট এডওয়ার্ডস ও প্যাট্রিক স্টেপটোর যৌথ প্রয়াসে বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুই ব্রাউন জন্মানোর মাত্র ৭০ দিনের মাথায় সুভাষের হাতে জন্ম নেয় বিশ্বের দ্বিতীয় তথা দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবি কানুপ্রিয়া। প্রভাত জানাচ্ছেন, দুর্গা নবরাত্রির মাঝে জন্ম হওয়ায় সুভাষ এবং তাঁর বাবা প্রায় একযোগেই কানুপ্রিয়ার ডাকনাম রাখেন দুর্গা।
এসএসকেএমে বিনামূল্যে প্রথম টেস্টটিউব বেবি জন্মানোর তিন দিনের মাথায় সোমবার প্রভাত বলছেন, ‘আমরা যখন সন্তানহীনতায় ভুগছিলাম, বিজ্ঞানের কাছে তখন কোনও উপায় ছিল না। সে সময়ে পথ দেখিয়েছিলেন সুভাষবাবু। কিন্তু এখন তো তা নয়। এখন তো আকছার আইভিএফ হচ্ছে সর্বত্র। কিন্তু টেস্টটিউব বেবির সুযোগ থেকে এখনও অসংখ্য মানুষ বঞ্চিত হন শুধুমাত্র টাকার অভাবে। সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না অধিকাংশেরই। এসএসকেএম হাসপাতাল সেই শূন্যস্থানটা ভরাট করে দিল। এ বড় খুশির খবর।’ তাঁর আশা, আগামী দিনে এই পরিষেবা নিশ্চয়ই ছড়িয়ে পড়বে বাংলার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালেও।