• বীভৎসতার আর এক নাম এখন গঙ্গারামচক
    এই সময় | ০৮ অক্টোবর ২০২৪
  • হেমাভ সেনগুপ্ত, খয়রাশোল

    চার দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থেঁতলে যাওয়া দেহাংশ। রক্ত-মাংস-অস্থি-মজ্জায় মাখামাখি খাদানের পাথুরে জমি। তার মধ্যেই প্রিয়জনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন পরিবারের লোকেরা। মানুষগুলিকে নয়, খুঁজছেন দেহের টুকরোগুলি। বীভৎসতার আরেক নাম এখন খয়রাশোলের গঙ্গারামচক কয়লাখনি। সাতসকালে মুড়ি খেয়ে বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়েছিলেন স্বামী। বলেছিলেন, দুপুরে ফিরে ভাত খাবেন। সোমবার সকালে গ্রামের সবাই হেঁকে বলেছিল, খাদানে 'বুম' ফুটেছে। শুনেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল ১৯ বছরের বুড়ি মারান্ডির।আট মাসের ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে হাঁটা ধরেছিলেন। পৌঁছে দেখলেন গাঁয়ের লোক পুলিশকে ধরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তার মাঝেই থেঁতলে যাওয়া মাংসপিণ্ডেই স্বামীকে খুঁজছিলেন বুড়ি। খুঁজতে খুঁজতে কিছু মাংসপিণ্ড পায়ের নীচে পিষেও যায়, কিন্তু সে সবে গা করেননি আর। শেষ পাথরের খাঁজে দেখতে পেলেন স্বামীর পরনের নীল জামার ছেঁড়া অংশ। মাথার খুলির অর্ধেকটা উড়ে গিয়েছে। জ্ঞান হারান বুড়ি।

    কোলের ছেলেটা সপাটে মাটিতে পড়ে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। গাঁয়ের এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে ছেলেটাকে কোলের তুলে নিলেন। কিন্তু বুড়ির মুখে জল জোগাবে কে? খাদান জুড়েই তখন কান্নার রোল! সোমবার সকালে যে ব্লাস্টিং হবে, তা আগে থেকেই ঘোষণা করে রেখেছিল খাদান কর্তৃপক্ষ। সেই মতো শনিবার থেকে পে-লোডার দিয়ে মাটি সমান করার কাজ শুরু হয়। সোমবার সকালেই বর্ধমানের কাজোরা গ্রাম থেকে ছুটি কাটিয়ে ডিউটিতে ফেরেন ব্লাস্টিং ইনচার্জ অমিত সিং (২৮)।

    পরিকল্পনা মতো খাদানে তিনটে লেয়ার তৈরি করা হয়। খোলামুখ খনির গায়ে মাটি সমান করে ব্লাস্টিংয়ের জন্য জায়গা মতো তিন ফুট অন্তর গর্ত খোঁড়া হয়েছিল। এ দিন সকালেই বিস্ফোরক বোঝাই গাড়িটি এনে দাঁড় করানো হয় একেবারে উপরের লেয়ারে। পাশেই ব্লাস্টিং প্লেস। ২৪ জন ব্লাস্টিং সেকশনে কাজ করা শ্রমিকদের তিনটি লেয়ারে ভাগ করে দেওয়া হয়। এরপর বুস্টার ভ্যান থেকে বিস্ফোরক নামানোর কাজ শুরু করেন শ্রমিকরা। তাঁদের সেফটির জন্য মাথায় টুপি আর পায়ে বুট জুতো। ব্যস, আর কিছু নেই।

    এক-একটা প্লটের জন্য ১০০-র বেশি সেট তৈরি করা হচ্ছিল। সে কাজ শেষ হলে হুডখোলা জিপে করে শ্রমিকরা নিজের প্লটে নিয়ে যাবেন। ইনচার্জ অমিত সিং গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে তদারকি করছিলেন। এ দিক, ওভারম্যান আসরাফ যাদবও তাড়া দেন। রবিলাল, সোমলাল, জয়দেবরা তাড়াহুড়ো করছিলেন। সেই সময়ে দু'নম্বর প্লটে কাজ করছিলেন শিবলাল মারান্ডি ও সুধাংশু ডোম। হঠাৎই বিস্ফোরণ ঠিক উপরের ধাপে। ছিটকে পড়লেন ওঁরা।

    তবে বরাতজোরে বেঁচেও গেলেন। তার পরে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না দু'জনেই। মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন। যেন কথা বলতে ভুলেছেন। পরে অবশ্য ক্ষোভ উগরে দিলেন খনির নানা অনিয়ম নিয়ে। সুধাংশু বলেলন, 'ব্লাস্টিংয়ের সময়ে কী কী নিয়ে সাবধান হতে হয়, তা আমাদের কোনও দিন জানানো হয়নি। তাই আজ এত জন চলে গেল!' শিবলাল বলেন, 'কোনও দিন ট্রেনিং দেওয়া হয়নি। স্রেফ দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে এ ভাবে মাল বাঁধতে হয়। তেমন করে যাই। কী করে জানব, এমন হতে পারে!'
  • Link to this news (এই সময়)