চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল: দেবতা ঘুমালে আমাদের দিন/দেবতা জাগিলে মোদের রাতি-‘ পতিতা’তে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর মধ্যেই সুপ্ত ছিল সমাজের অন্ধকারে ডুবে থাকে বেশবণিতাদের অসহায় জীবন। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি অনেক পরিববর্তন হয়েছে। যৌনকর্মীরা পেশাদার হিসাবে মান্যতা পেয়েছেন। তবে আজও উপেক্ষিতই তাঁরা।
এবার সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কুলটির নিষিদ্ধপল্লিতে নিজেরাই শুরু করলেন দেবী মহামায়ার আরাধনা। প্লাবনের জোয়ার ভেঙে গিয়েছে সাম্প্রদায়িক বাঁধ। পুজো কমিটির সম্পাদক গায়েত্রী বিশ্বাস। সভাপতি মর্জিনা বিবি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলছেন গায়েত্রী বিশ্বাস, জ্যোতি সাউ, অমৃতা কউররা। সঙ্গে থাকছেন মর্জিনাও।
দেশের অন্যতম বৃহৎ নিষিদ্ধপল্লি কুলটির চবকা আর লছিপুর। চবকা এলাকায় দেহোপজীবীর সংখ্যা ৫৪৫,আর লছিপুরে ৯৩২। নিষিদ্ধপল্লিতে চলছে পুজোর প্রস্তুতি। শুরু হয়েছে মণ্ডপ তৈরির কাজ। সাফ সুতরো হচ্ছে এলাকা। সব কাজ খতিয়ে দেখছেন মর্জিনা বিবি, জ্যোতি সাউরা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে উৎসবে মেতেছেন সবাই। এমনকি বাড়ি বাড়ি চাঁদাও তুলছেন তাঁরা।
পুজোয় জমজমাট থাকে নিষিদ্ধপল্লি লছিপুর, চবকা ও সীতারামপুর। কিন্তু তাঁদের ছিলনা কোনও পুজো। পুজোয় মাকে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও উপায় তাঁদের ছিল না। কারণ সমাজে তাঁরা অস্পৃশ্য। তবে সমাজের চোখে পিছিয়ে থাকা মহিলাদের সেই পুজো শুরু হয়েছ। তাঁদের পুজো এবার পাঁচ বছরে পা দিল। এবার থেকে সরকারি অনুদানও মিলছে এই পুজোতে।
দুর্বার মহিলা সমিতির দাবি, দেহোপজীবীদের এই পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন পাশের গ্রাম চন্দনতলা, বটতলা, ঘাটালের গ্রামের বাসিন্দারা। ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় চারদিন। জানা গিয়েছে, বেলরুইয়ের জমিদার, রায় পরিবারের হাত ধরেই নাকি এখানে এসেছিলেন বারবণিতারা। তাঁদেরই জমিতে এখানে নিষিদ্ধপল্লি তৈরি হয়েছে। আর সেই পরিবারের বদান্যতায় দুর্গাপুজো শুরু। সার্বিকভাবে বারবণিতারা উদ্যোগ নিলেও এই রায় পরিবারের সদস্যরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। জমিদার বাড়ির পক্ষে শিবদাস রায় জানান, ‘তাঁরা এখনও পর্যন্ত দেহোপজীবীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেন এবং পাশে রয়েছেন।’
মায়ের মূর্তির কাঠামোয় তাঁদের বাড়ির মাটি এনেই প্রথম প্রলেপ পড়ে। কিন্তু তাঁরাই থাকেন পুজোয় ব্রাত্য। কোনও মন্দিরে তাঁরা অবাধে যাতায়াত করতে পারেন না। তাঁরা হলেন পতিতাপল্লির বাসিন্দা। তাঁরা নিজেরাই পুজোয় ফল কাটবেন, নিজেরাই ভোগ রান্না করবেন, নিজেদের ইচ্ছামতো পুজো করবেন। আবার সকলে দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন।