• কেন যে মাস মাইনের লোভে সবাই রাজি হল মাইন করতে!
    এই সময় | ০৯ অক্টোবর ২০২৪
  • এই সময়, খয়রাশোল: স্বামীকে হারিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছেন তিনি। বোধনী হেমব্রম কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলছেন, ‘শালপাতা-কেন্দুপাতা-পিয়াল ফল তুলে দিব্যি সংসার চলছিল। মাস মাইনের লোভে খনিতে কাজ করতে যাওয়াই কাল হলো!’ মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে কেঁদেই চলেছেন বোধনী। স্বামী সোমলাল হেমব্রমকে হারানোর পর। বীরভূমের খয়রাশোল ব্লকের গঙ্গারামচক কয়লা খনি লাগোয়া, জঙ্গলঘেরা বাস্তবপুর গ্রামে এখন এমনই হা-হুতাশ ঘরে ঘরে।

    অস্থির হয়ে উঠেছে বোধনীর দুই মেয়ে, ক্লাস নাইনের চাঁদনি ও ক্লাস সেভেনের রেশমি। চাঁদনির কথায়, ‘ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে আমরা এ জঙ্গলেই পিয়াল ফল তুলতে যেতাম। মা ও সব ফল খয়রাশোলের হাটে বেচতে যেত। ওখানেই তো খনি হলো। বাবা কাজ পেল...।’ 'কথা বন্ধ হয়ে আসে তার। পাশেই ছিলেন প্রতিবেশী শুকুমণি টুডু। বললেন, ‘আমরা জল-জমি-জঙ্গল নিয়েই বেঁচেছিলাম। জঙ্গল কেটে খনি করার সময়ে আমরা পথে নেমেছিলাম। আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারিনি।’

    সোমবার সকালে একটা বুস্টার ভ্যান প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক নিয়ে যাচ্ছিল খোলামুখ কয়লাখনিতে ব্লাস্টের জন্য। কিন্তু সেই ভ্যানে বিস্ফোরণের জেরে প্রাণ হারান ৮ জন শ্রমিক। বীরভূমের লোকপুর এলাকার গঙ্গারামচক মাইনিং প্রাইভেট লিমিটেডের খোলামুখ কয়লাখনির ঘটনা।

    ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়লা ব্লক বণ্টন আইনের আওতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম রাজ্যে যে পাঁচটি কোল ব্লক থেকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব পায়, সেই তালিকায় নাম ওঠে খয়রাশোলের বড়জোড় ও গঙ্গারামচক মৌজার। কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন না মেলায় ২০১৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেখানে কয়লা তোলা যায়নি।

    জট কাটিয়ে ২০১৭ সালের শেষ দিকে খয়রাশোলের কৃষ্ণপুর-বড়জোড় মৌজা থেকে কয়লা তোলার প্রস্তুতি শুরু করলেও জটিলতা ছিল গঙ্গারামচক নিয়েই। কারণ, এ মৌজার একটি বড় অংশে ছিল বিশাল জঙ্গল। ওই অঞ্চলের ১০১ হেক্টর জায়গা নিজেদের নামে নিয়ে সেখানে জঙ্গল কাটাতে শুরু করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম।

    তা নিয়েই আপত্তি তুলে প্রস্তাবিত খনি এলাকা সংলগ্ন আদিবাসী প্রভাবিত বাস্তবপুর, সগড়ভাঙ্গা, বেলডাঙা, ভাদুলিয়া, গঙ্গারামচক, দেবগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দারা তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনকারী বাবুরাম পাঁউরিয়া, সুমিতা সরেন, তাপস মারান্ডি, মলিন্দ টুটুদের অভিযোগ ছিল, বনভূমি কেটে ফেলায় তাঁদের জীবন-জীবিকায় আঘাত আসবে। থাকবে না প্রচুর বন্যপ্রাণও। কিন্তু তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রাখার জন্য প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে সরকার কড়া হওয়ায় আন্দোলন তেমন দানা বাঁধতে পারেনি। দোরে দোরে গিয়ে পরিবার পিছু খনিতে মাস মাইনের ‘টোপ’ও দেওয়া হয়, এমনটা অভিযোগ।

    পিডিসিএল (পাওয়ার ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড) কর্তৃপক্ষ গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বোঝাতে সক্ষম হন যে, আদিবাসী পরিবারের যে কোনও ছেলে ১৮ বছর হলেই খনিতে কাজের সুযোগ পাবে। আন্দোলন থেকে সরে আসেন এলাকার তরুণদের অনেকেই। জঙ্গল কেটে খনি তৈরিতে শেষমেশ সম্মতি দেন এলাকাবাসী। প্রতিশ্রুতি মতো খনিতে কাজও মিলতে শুরু করে। সে দিনের আন্দোলনকারীদের এক জন, সোমলাল হেমব্রমও কাজ পেয়েছিলেন ব্লাস্টিং সেকশনে। সোমবারের ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ গিয়েছে তাঁর। স্ত্রী বোধনী আফশোস করছেন, ‘সে দিন বার বার বলেছিলাম, আমাদের জঙ্গলই ভালো। অভাব থাকলেও কোনও দিন না-খেয়ে থাকতে হয়নি। দু’টো পয়সার লোভে আজ আমাদের সব গেল।’

    বাস্তবপুর গ্রামেরই মণি মুর্মু তাঁর স্বামী জয়দেব মুর্মুকে হারিয়ে তিন মেয়ে, এক ছেলেকে নিয়ে জলে পড়েছেন। মণি বললেন, ‘সে দিন মাস মাইনের লোভে সবাই মাইন করার জন্য রাজি হয়ে গেল। সে জন্যই আজ এত বড় বিপদ হল!’

    গ্রামে ৪৩ ঘর আদিবাসী পরিবারের হেঁশেলে আগুন জ্বলেনি মঙ্গলবারও। অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। কখন সিউড়ি থেকে প্রিয়জনদের ক্ষতবিক্ষত দেহ বা দেহাংশ শেষ বারের মতো ঘরে ফিরবে! আর বাতাসে ভাসছিল দীর্ঘশ্বাস মেশানো আফসোস— ‘কেন যে সে দিন খনি করতে সায় দিয়েছিলাম!’

    মঙ্গলবার সকালে ৮টি মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয় সিউড়ি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। বিকেলে গ্রামে পৌঁছয় দেহগুলি। এ দিন সকাল থেকেই দফায় দফায় পিডিসিএল-এর লোকজন খনি এলাকায় এসেছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ফের কাজ শুরু করতে চান তাঁরা। কারণ পুজোর মুখে কয়লা সরবরাহ বন্ধ হলে রাজ্যের একাধিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন ব্যাহত হবে।

    তাই, তড়িঘড়ি মৃতদের পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দিতে তৎপর প্রশাসন। এ দিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পিডিসিএলের চেয়ারম্যান পিবি সেলিম বলেন, ‘এই অবস্থা নিয়ে বলার ভাষা নেই। পরিবারের সঙ্গে আছি বলেই আমি সোমবার থেকে এখানে আছি। সব রকম সাহায্য করা হচ্ছে।’

    মঙ্গলবার রাতে বীরভূমের জেলাশাসক বিধান রায় ও জেলা সভাধিপতি কাজল শেখ ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেন মৃতদের বাড়িতে গিয়ে। এক-একটি পরিবারকে দেওয়া হয় ৩২ লক্ষ টাকার চেক।

    কিন্তু এলাকায় ক্ষোভ থামছে না। মৃত জয়দেব মুর্মুর ভাই ডাব্লু মুর্মু বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের সব কিছু না-পাওয়া পর্যন্ত খনি বন্ধ থাকবে। খুলতে দেবো না।’ একই কথা খুদু মুর্মুরও— ‘শুধু চেক দিলে হবে না। পরিবারের লোকের চাকরি চাই। যতদিন না পাব, ততদিন মাইন খুলতে দেবো না।’
  • Link to this news (এই সময়)