সংবাদদাতা, বোলপুর: শান্তিনিকেতন শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থক্ষেত্র। বল্লভপুর অভয়ারণ্য সংলগ্ন বনের পুকুর ডাঙার হিরালিনী দুর্গোৎসব সেই শিল্প ও সংস্কৃতির দুই ডানায় ভর করে উড়াল দিয়েছে। জেলার সেরা পুজোগুলির একটি হিসেবে মান্যতা পায় এই পুজো। বাড়তি হিসেবে শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে দর্শনার্থীদের পাওনা হয় পরিবেশও। এই তিনের মেলবন্ধনে রাজ্যের যে কোনও থিমের পুজোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে হিরালিনী দুর্গোৎসব।
শিল্প ও আদিবাসী সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের শিল্পী বাঁধন দাসের হাত ধরে ২০০১ সাল থেকে পথচলা শুরু হিরালিনী দুর্গোৎসবের। দু’ বছরের মধ্যেই শিল্পীর অকাল মৃত্যু হলেও থেমে থাকেনি পুজো। বরং আদিবাসীদের উৎসাহে উদ্দীপনায় পুজো ২৩ বছর অতিক্রম করে ফেলেছে। এখানে মোট পাঁচটি মূর্তি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়। ঠাকুরের হাতে অস্ত্রের পরিবর্তে রাখা হয় পদ্মফুল, যা শান্তির প্রতীক। এ বছর বাঁশের মূর্তি পুজো করা হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির অন্যতম কর্তা আশিস ঘোষ। তবে প্রস্তুতিতে বারবার বাধা সৃষ্টি করেছে বৃষ্টি। আবহাওয়া অনুকূল হতেই কাজ প্রায় শেষের পথে। মহালয়ার পুণ্যতিথিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভার্চুয়ালি এই পুজোর উদ্বোধন করেন।
শরৎকালে শান্তিনিকেতনের বল্লভপুর অভয়ারণ্য সংলগ্ন বনের পুকুর ডাঙার খোয়াইয়ের প্রকৃতি অপরূপা হয়ে ওঠে। একদিকে, ময়ূরাক্ষী সেচ ক্যানালের জলধারা। অন্যদিকে, খোয়াইয়ের লালমাটি ভরে যায় সোনাঝুরির রেণুতে। ক্যানালের নীচের অংশে পর্যাপ্ত জলে স্থানীয় আদিবাসীরা এই সময় ধান চাষ করেন। সবুজে সবুজ হয়ে ওঠে চতুর্দিক।
২০০১ সালে যখন আদিবাসীদের সঙ্গে নিয়ে শিল্পী বাঁধন দাস এই পুজো শুরু করেন, তখনও গড়ে ওঠেনি খোয়াইয়ের হাট। ফলে পরিবেশ ছিল শান্ত, নিরিবিলি। প্রথম বছর শিল্পী টেরাকোটার মূর্তি নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় বছর তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। ক্রমেই পুজোটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এরপরই ঘটে ছন্দপতন! ২০০২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বাঁধন দাসের। এরপর থেকে পুজোর দায়িত্ব নেন তাঁরই ছাত্র শিল্পী আশিস ঘোষ। তিনি পরপর তিন বছর বাঁশ, ফাইবার কাস্টিং ও লোহা দিয়ে নতুন নতুন দুর্গামূর্তি তৈরি করেন। ফলে মোট দুর্গামূর্তি সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচে। বিসর্জনের রীতিকে বিসর্জন দিয়ে পাঁচটি মূর্তিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করাই এই পুজোয় রীতি হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবছরই নতুন নতুন রং ও সাজসজ্জায় মূর্তিগুলিকে নতুন করে সাজানো হয়। পুজো প্রসঙ্গে আশিসবাবু বলেন, গতবছরের মতো এবারও ভার্চুয়ালি পুজোর উদ্বোধন করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই পুজোয় অংশগ্রহণ করার জন্য আদিবাসীরা মুখিয়ে থাকেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এমনকী, প্রতিবেশী বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকেও আসেন মানুষ। মহাসপ্তমী থেকে মহানবমী, তিনদিন দেবীমূর্তির সামনে দিনের বেলায় তাঁরা নাচ প্রদর্শন করেন। পাশেই নির্মিত মঞ্চে ধামসা, মাদল নিয়ে অনুষ্ঠান করে দর্শনার্থীদের মাতিয়ে দেন। সবশেষে দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের মাধ্যমে পুজোর সমাপ্তি ঘটে।