পুজোর মরশুমেই বিক্রি হয়েছিল ‘শ্রীরামপুর’, ১৭৯ বছর আগের সেই ইতিহাসই বিস্মৃতির অতলে
বর্তমান | ০৯ অক্টোবর ২০২৪
অভিজিৎ চৌধুরী, চুঁচুড়া: শরতের মেঘ সেই সময় নিয়মমাফিক জমতে শুরু করেছে। বাতাসে ভাসছে শিউলির গন্ধ। দুর্গাপুজো নিয়ে এমন মাতামাতি না থাকলেও শারদীয়ার আবেগ ছিল টানটান। তেমনই একদিনে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ‘শ্রীরামপুর’। হুগলির গঙ্গাপাড়ে সাবেক দিনেমার বাণিজ্য কলোনির হাতবদল হয়েছিল। তদানীন্তন ভারতের আরও দু’টি বাণিজ্য তালুকের সঙ্গে ‘শ্রীরামপুর’ও ১২ লক্ষ টাকায় বেচে দিয়েছিলেন ডেনমার্কের রাজা। সেটি কিনেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পুজোর গন্ধমাখা সেই দিনটি ছিল ১৮৪৫ সালের ১১ অক্টোবর। পালা বদলের পর শ্রীরামপুর নামটিও ফিরে পেয়েছিলেন নাগরিকরা। ইংরেজ বণিক শাসনের হাত ধরে ডেনমার্কের ‘ফ্রেডরিক নগর’ ফের হয়ে উঠেছিল শ্রীরামপুর।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস বিস্মৃত হতে বসেছে। যদিও এই বিষয়টির সঙ্গে বাঙালির আবেগ তেমন জড়িয়ে ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। শ্রীরামপুরের সেকালের মানচিত্রের সঙ্গে আজকের মানচিত্রের সামান্য তফাত রয়েছে। তবে পুজো মরশুমে ‘শ্রীরামপুর’ নামটি ফিরে পাওয়ার বিষয়টি আজও কারও কারও স্মৃতিতে দোলা দিয়ে যায়। তদানীন্তন সময়ের পঞ্জিকার হদিশ বিশেষ মেলেনি। তবে একটি ক্যালেন্ডার মতে, ১৮৪৫ সালের ১০ অক্টোবর ছিল দশমী। পরের দিন ১১ অক্টোবর পুনর্জন্ম হয়েছিল ‘শ্রীরামপুর’-এর। ওই ক্যালেন্ডারের তথ্য নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু ‘শ্রীরামপুর’ নাম ফিরে পাওয়ার বিষয়টি যে পুজোর মরশুমেই হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার উদাহরণ সুধীর মিত্র লিখিত হুগলির ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থে পাওয়া যায়। সুধীরবাবু লিখেছেন, দিনেমাররা চলে যাওয়ার পর তাদের প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘ওয়েলফেয়ার কমিটি’ হয়ে ওঠে ‘শ্রীরামপুর হিতকারিণী সভা’। ওই সভার কার্যালয় পরে শ্রীরামপুরের প্রথম পাবলিক লাইব্রেরিতে পরিণত হয়।
শ্রীরামপুরের ইতিহাস ও সামাজিক জীবন নিয়ে চর্চা করেন শহরের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকর্তা সমীর সাহা। তিনি বলেন, দু’টি বণিক শক্তির মধ্যে ভূমির হাতবদল নিয়ে তখনকার মানুষ হয়তো বিশেষ ভাবতে চাননি। তাই পুজো মরশুমের প্রসঙ্গটি সেভাবে সামনে আসেনি। তবে শ্রীরামপুরের বাণিজ্য তালুককে ফ্রেডরিক নগর করেছিল দিনেমাররা এবং পরে আবার হাতবদলের জেরে তা শ্রীরামপুর হয়েছিল, এটি ঐতিহাসিক সত্য। আধুনিক প্রজন্মের জন্য সেই বিস্মৃত ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ।
মজার কথা, পুজোর মরশুমে শ্রীরামপুরের তালুক পেতে পারতেন এক বাঙালিও। ইতিহাস বলে, দিনেমারদের কাছ থেকে শ্রীরামপুর কিনতে চেয়েছিলেন তাদেরই বাঙালি দেওয়ান ও মুৎসুদ্দি। তাঁরা হরিনারায়ণ ও রঘুনাথ গোস্বামী। ইংরেজরা সেই চেষ্টা ভেস্তে দেয়। নাহলে হয়তো ১৮৪৫ সালের অক্টোবরের শারদীয়া ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।