একটা দুটো নয়, একেবারে ১৯টা। ১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত রাজ্য পুলিশকে কার্যত নাস্তানাবুদ করে ৩৭-এর এই যুবক বেছে বেছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে গিয়েছেন। তাঁর স্লোগান ছিল — ‘বিনা রক্তপাতে, ভদ্রতার সঙ্গে ডাকাতি করব।’অপরাধ জীবনে সেই ডাকাতের অস্ত্র ছিল একটাই, একটি খেলনা পিস্তল! যা দেখে আতঙ্কে গুটিয়ে যেতেন বাঘা বাঘা পুলিশ কর্তারাও। সেই ডাকাত সর্দার শেখ একলাস এখন সব কিছু ছেড়ে আদালতের মুহুরি। গত প্রায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ওটাই এখন একলাসের পেশা এবং নেশাও।
পুলিশের কেস ডায়েরি বলছে, ২০০৩-এর ৮ অগস্ট দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে সাতগাছিয়ার রায়পুরের বাসিন্দা ধরা না-পড়লে আচ্ছা আচ্ছা গোয়েন্দা অফিসারের ঘুম ছুটিয়ে দিতেন এতদিনে। একলাসের নিজের কথায়, ‘পরিবারের লোকেরা আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ করে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেখানে পরিচয় হয় কাঁকিনাড়ার ব্যাঙ্ক ডাকাত শ্যামল চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি আমাকে ডাকাতি করার বুদ্ধি দেন। জেলে বসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ডাকাতি করলে ছোটখাটো জায়গায় করব না, একেবারে ব্যাঙ্কের ভল্টে থাবা বসাব। জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরে বৌ-বাচ্চাদের খাবার কিনে দেওয়ার মতো টাকা ছিল না। এরপর শ্যামলের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করি। এক থেকে দুই, শেষ পর্যন্ত ডাকাতির সেই সংখ্যাটা ১৯-এ গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ধরা পড়ে যাই। দলের এক সদস্য গদ্দারি করেছিল আমার সঙ্গে।’
বর্তমানে ষাটোর্ধ একলাসের দুটো হাতই প্রায় অকেজো। সেটা অবশ্য সেই ডাকাত-জীবন থেকে। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘২০০২ নাগাদ বহরমপুরের পঞ্চাননতলার সমবায় ব্যাঙ্কে ১৩ লক্ষ টাকা ডাকাতি করেছিলাম। হাতে একটা খেলনা পিস্তল এবং খেলনা বোমা নিয়ে ভয় দেখিয়ে উপস্থিত সকলকে বলি, আমরা বেকার ছেলে। কারও ক্ষতি করতে চাই না। শুধু ব্যাঙ্কের সিন্দুক থেকে টাকা নিয়ে চলে যাব। পরের দিন কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বিবৃতি দেন, কে এই ডাকাত, যে থানার উপরে থাকা ব্যাঙ্কে ডাকাতি করে চলে গেল!’
ছোটবেলা থেকে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা একলাসের শেষ অপারেশন হাওড়ার উলুবেড়িয়ায়। সেখানকার সমবায় ব্যাঙ্কে ডাকাতি করার সময়ে হাতে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এক যুবক। তিনি একলাসকে বলেন, ‘আমার কাকার মেয়ের বিয়ের টাকা। উনি আসতে পারেননি তাই আমাকে তুলতে পাঠিয়েছেন।’ দলের সদস্যদের ডাকাত সর্দার নির্দেশ দেন, ‘ওটা কাজের টাকা। কেউ নেবে না।’
এরপর যুবককে গেট খুলে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। ওই ঘটনার পরে উলুবেড়িয়া থানার এক পুলিশ অফিসার নিজের নেটওয়ার্কে ডাকাতদলের মধ্যে সোর্স ফিট করে ফেলেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ডেকে পাঠানো হয় একলাসকে। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ঠাঁই হয় সংশোধনাগারে। ওখানে বসেই আইন নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেন তিনি। একদিন কাজের সূত্রে আলিপুর জেলে গিয়েছিলেন আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানতে পারেন একলাসের কথা। মূলত তাঁর উদ্যোগে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে ২০১০-এ মুক্ত হন ‘ডাকাত একলাস।’ এরপর জয়ন্তর কাছেই বর্তমানে কাজ করছেন তিনি।
একলাসের কথা জানতে পারেন চিত্র পরিচালক নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও। টানা তিন বছর ধরে একলাসের কাছ থেকে তাঁর ডাকাত জীবন নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন তাঁরা। সেই সত্যি ঘটনার উপরে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে ‘বহুরূপী।’ যা পুজোতে সিনেমা হলে দেখতে পাবেন দর্শকরা।