ঐতিহ্য বাঁচাতে এখনও চালচিত্র আঁকেন কৃষ্ণনগরের অশীতিপর শিল্পী রেবা পাল
বর্তমান | ১০ অক্টোবর ২০২৪
অগ্নিভ ভৌমিক, কৃষ্ণনগর: বয়সের ভারে শরীর ঝুঁকে পড়েছে। পুরু কাঁচের চশমার আড়াল থেকে কোনওরকমে দেখেন। হাঁটুর জোর আর নেই। তবে মনের জোর অগাধ। বয়সের কারণে ছবি আঁকতে গেলেই হাত কাঁপে। বয়স আশি পেরলেও গলার স্বর এখনও ভাঙেনি। স্পষ্ট বাংলায় কথা বলতেই পছন্দ করেন কৃষ্ণনগরের চালচিত্রের শিল্পী রেবা পাল। কাঁপা কাঁপা হাতেই চালচিত্রের উপর এঁকে চলেন দেবদেবীর ছবি। নিপুণ হাতের সেই কাজ বর্তমানে খুব একটা দেখা যায় না। নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত না হওয়ায় আক্ষেপের সুর রেবা পালের গলাতে। যদিও নতুন প্রজন্মের এই অনীহার যথার্থতা রয়েছে বলেই তিনি মনে করেন। কারণ বর্তমান চালচিত্রের চল কমে যাওয়ায় উপার্জন হয় না। শুধুমাত্র চালচিত্র এঁকে সংসার চালানোর দিন আর নেই বলেই তিনি মনে করেন। কিন্তু স্বামীর ছেড়ে যাওয়া পেশা তিনি আজও ছাড়তে পারেননি। দুর্গাপূজা এলেই ভাঙা টালির চালের নীচে আপন মনে চালচিত্র আঁকেন। বয়সের ভার শিল্পসৃষ্টিতে ছাপ ফেলেনি আজ অবধি। দূর দূরান্ত থেকে অনেক খদ্দের আসেন তাঁর চালচিত্র কিনতে। যদিও তা বর্তমানে অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু বাংলার ঐতিহ্যশালী এই শিল্প জীর্ণ চালের নীচে শীর্ণ বৃদ্ধার হাত ধরেই বেঁচে রয়েছে।
ভাঙাচোরা ছোট্ট টালির বাড়ির বারান্দায় বসে আপন মনে চালচিত্র এঁকে চলেন তিনি। ছবি আঁকার সময় পুরু কাঁচের চশমায় ভেসে ওঠে শিব, দুর্গা, রাধাকৃষ্ণের প্রতিচ্ছবি। তুলির প্রতি টানে জীবন্ত হয়ে ওঠে সেইসব চরিত্র। শুধুমাত্র ব্যবসার স্বার্থে নয়, ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতেই তিনি এঁকে চলেছেন চালচিত্র। গোটা বারান্দাজুড়ে চাঁদমালার মতো তৈরি করেছেন চালচিত্র। বর্তমানে বিভিন্ন দোকানে প্রিন্টেড চালচিত্র দেখ যায়। কিন্তু হাতে আঁকা এরকম চালচিত্র অমিল। কথা প্রসঙ্গে রেবাদেবীর কাছ থেকে জানা গেল, বিক্রিবাটা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। আগে কুমোরটুলিতেও তার হাতে আঁকা চালচিত্র পৌঁছে যেত। রীতিমতো ১০০ থেকে ১৫০ বান্ডিল তিনি ও তাঁর স্বামী কুমোরটুলিতে দিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন সেখানে প্রিন্টেড চালচিত্রের চল বেড়েছে। যার ফলে হাতে আঁকা চালচিত্রের বিক্রি নেই বললেই চলে। তাই শ্বশুরবাড়ির ধারাকে জীবিত রাখাই লক্ষ্য রেবা পালের।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্বামী ষষ্ঠী পালের সঙ্গে সংসার শুরু করেছিলেন। স্বামীর হাত থেকেই চালচিত্র আঁকা শেখা। বিয়ের ক’দিন পরই স্বামী রেবাদেবীকে বলেন, ‘এবার থেকে চালচিত্রের তুলির টান দেবে তুমিও।’ সেই থেকেই শুরু হয়েছিল রেবা দেবীর চালচিত্র আঁকা। যা স্বামীর মৃত্যুর ২১ বছর পরেও থামেনি। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা চালচিত্রে আঁকছে না। এখন শুধুই প্রিন্টেড চালচিত্র দেখা যায়। কিন্তু একসময় আমি আমার স্বামী কলকাতায় চালচিত্র বিক্রি করতে যেতাম। সারাদিনে ভালো বিক্রিও হতো। এখন সেসব দিন আর নেই। শুধুমাত্র চালচিত্রে একে সংসার চলবে না। যার জন্যই নতুন প্রজন্ম এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না।’
কৃষ্ণনগর ঘূর্ণি এলাকার গলির শেষ মাথায় ভাঙা টালির চালের ঘরে তিনি থাকেন। বাড়ির চারপাশ আগাছায় ভর্তি। বৃষ্টির দিনে সেই ভাঙা টালির গা চুয়ে চুয়ে জল পড়ে বারান্দায়। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েও এঁকে চলেন দেবদেবীদের ছবি। আঁকার সময় যেন যৌবন ফিরে পান রেবাদেবী। সেসব দিনের কথা ভাবলে চোখের কোণটা এখনও ভিজে আসে তাঁর। -নিজস্ব চিত্র