মেয়েকে নিয়ে প্যান্ডেলে, রেস্তোরাঁয় জুড়তে পারে ভেঙে যাওয়া সম্পর্কও
এই সময় | ১০ অক্টোবর ২০২৪
'ও মা, আগে কেন এমন হলো না?' দুর্গার যখন বাবার ঘর আলো করে আসার সময়, তখন বাবার থেকে অনেক দূরে বেড়ে উঠেছে সে। পুজোর আনন্দ বোঝার বয়সই যখন হয়নি, তখন থেকে সে মায়ের কাছে। আলাদা। একটু একটু করে পুজোর আলো, প্যান্ডেল, ঠাকুর দেখতে শিখেছে। অষ্টমীর সন্ধেয় ছোট্ট হাত বেয়ে গলে পড়েছে আইসক্রিম। আর সেই ঠাকুর-দেখা ভিড়ে ছোট্ট মন চুঁইয়ে একফোঁটা কষ্ট কি ঝরে পড়েনি সবার অলক্ষ্যে? ওই যে বাবার কোলে উঠে মণ্ডপের আলো ছুঁয়ে দেখছে তারই মতো একজন। তার কাছে তো বাবা নেই!আট বছরের সেই নিষ্পাপ চোখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বেলে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। বাবা-মায়ের ঝগড়া। তিন বছর বয়স থেকেই মায়ের সঙ্গে সে। মাঝের এই পাঁচটা পুজোয় বাবার আঙুল ছুঁয়ে যায়নি তার একরত্তি আঙুল। এ বার যাবে। বাবার সঙ্গে থাকবে মা-ও। তিন জন মিলে ঘুরবে, খাবে। ডিভোর্সের একটি মামলায় হাইকোর্টের কড়া নির্দেশে ছোট্ট জীবনে বোধন হয়েছে অফুরান আনন্দের। খুদে 'দুর্গা' এ বার বাবার কোলে চড়ে ঠাকুর দেখতে যাবে! বাবা-মায়ের সঙ্গে শপিং হয়ে গিয়েছে। বাবার কাছে আব্দার করে একটা ঘড়িও কিনে ফেলেছে। ঠিকই তো... সময়ের পক্ষীরাজে উড়াল দিয়েছে ছোট্ট দুটো ডানা।
ক্লাস ইলেভেন থেকেই বন্ধুত্ব। একটু একটু করে কাছে আসা। উচ্চশিক্ষা শেষে নৈহাটির তরুণ কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে, আর যুবতী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিচার। ১১ বছরের বন্ধুত্ব দাম্পত্যে বদলে যেতে বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ২০১৬-য় ঘর আলো করে আসে 'দুর্গা'।
বন্ধুত্বের দৃঢ় বাঁধনের ফাঁক গলে সময়ের সঙ্গে ঢুকে পড়ে ইগো। দু'জনে দু'টি ভাসমান দ্বীপের মতো ক্রমশ সরে যেতে থাকেন। তিন বছরের মেয়ে নিয়ে তরুণী চলে যান বাপের বাড়ি। মা, দিদার ছায়ায় বেড়ে ওঠে শিশুটি। মাঝেমধ্যে দেখা হতো বাবার সঙ্গে। কিন্তু ডিভোর্সের মামলা শুরুর পরে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
সন্তানের দেখা পেতে নিম্ন আদালত ঘুরে হাইকোর্টে পৌঁছন বাবা। বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন এবং বিচারপতি সুপ্রতীম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ নিম্ন আদালতে জমা পড়া নথি দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে। বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ ছিল — বাবার সঙ্গে দেখা না-করা নিয়ে শিশুটি নিম্ন আদালতকে যা বলেছে, তা ছিল শিখিয়ে দেওয়া। ওইটুকু শিশু নিজে থেকে সে কথা কোনও ভাবেই বলতে পারে না, দাবি ডিভিশন বেঞ্চের।
গত মে-তে আদালতের নির্দেশে নিয়োজিত স্পেশাল অফিসার, আইনজীবী জুঁই দত্ত চক্রবর্তীর সামনে সপ্তাহে দু'দিন মায়ের বাড়িতেই ঘণ্টা তিনেক মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতেন বাবা। তিন মাস পরে জুঁই আদালতকে তাঁর পর্যবেক্ষণ জানিয়ে রিপোর্ট দেন। এর মধ্যে মামলা চলে যায় বিচারপতি মধুরেশ প্রসাদের ডিভিশন বেঞ্চে। স্পেশ্যাল অফিসারের রিপোর্ট দেখে সেই বেঞ্চ জানায়, ইগো ছেড়ে বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের মঙ্গল দেখা। আদালতের নির্দেশ, সপ্তাহে দু'দিন নিজের বাড়িতেই মেয়ের সঙ্গে দেখা করবেন বাবা।
বেঁকে বসে মেয়ে। নানা অছিলায় বাবার বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত গিয়েও ফিরে আসে। কোর্টের পর্যবেক্ষণ, মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে মা তাকে নানা ভাবে বোঝাচ্ছেন। কড়া মনোভাব নিয়ে কোর্ট সুস্থ পরিবেশে শিশুর বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে বলে। বাবা-মায়ের কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি সন্তানের ভালোর জন্য যা প্রয়োজন, তা না-করলে কঠোর পদক্ষেপের হুমকি দেয় আদালত।
এর পরেই বদলায় চালচিত্র। গত সপ্তাহে আদালতে বিচারপতিদের সামনে দু'জনেই জানান, তাঁরা একসঙ্গে থাকতে না-পারলেও সন্তানের জন্য নিয়মিত দেখা করবেন। তার পরেই শপিং মল। মেয়ের পুজোর ড্রেস কিনেছেন। বাবার কাছে মেয়ের আব্দার শুনে মায়ের মুখে তখন হাসি।
বলছেন, 'পুজোয় তিন জন ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছি। অনেক দিন পর আবার গঙ্গা পেরিয়ে চুঁচুড়া যাব একদিন। সারা দিন ঠাকুর দেখে কোনও রেস্তোরাঁয় খেয়ে ফিরব।' বাবা আবার নতুন খাতা-পেনসিল কিনে দিয়েছেন। মা বলছেন, 'ও বাবার কাছে পড়লে রেজ়াল্ট ভালো করবে।'
আদালত বলেছে, পুজোর পরেও এ ভাবেই যেন তাঁরা আগলে রাখেন মেয়েকে। কে জানে.... পুরোনো সময় হয়তো কড়া নাড়তে পারে কখনও.....