সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়, কোচবিহার: কোচবিহারের দুর্গাপুজো মানেই বড়দেবীর পুজো। শুধু এ জেলাই নয়, গোটা উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে বড়দেবীর পুজোর অন্য আবেগ। কোচবিহার শহরবাসী এখনও বড়দেবীর প্রতিমা দর্শনের মধ্য দিয়েই তাঁদের পুজো পরিক্রমা শুরু করেন। প্রাচীন রীতিনীতির মধ্যে দিয়ে মাস খানেক আগে থেকেই বড়দেবীর পুজোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বুধবার সকালে দেবীবাড়িতে বড়দেবীর মন্দিরে মহাষষ্ঠীর পুজো হয়। সন্ধ্যায় বিল্ববরণ হয়েছে। একইভাবে মদনমোহন মন্দিরের কাঠামিয়া মন্দিরেও সন্ধ্যায় বিল্ববরণ হয়। এই উপলক্ষ্যে বড়দেবীর মন্দিরে পাঁঠা ও কাঠামিয়া মন্দিরে পায়রা বলি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, বাণেশ্বর মন্দির থেকে দুই জোড়া বেল কাঠামিয়া ও বড়দেবীর মন্দিরে আনা হয়েছে। ষষ্ঠী পেরিয়ে আজ, বৃহস্পতিবার সপ্তমীতে দুই মন্দিরে মহাসপ্তমীর পুজো হবে। দুই জায়গায় পাঁঠাবলি হবে আজ। অষ্টমীতে বড়দেবীর মন্দির, কাঠামিয়া মন্দির ও গোসানিমারি মন্দিরে মহিষ বলির জন্য মহিষ আনা হয়েছে।
বুধবার ষষ্ঠীর সকাল থেকেই কোচবিহার শহর সহ জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ভক্ত বড়দেবীর মন্দিরে আসেন। কাঠামিয়া মন্দিরের দুর্গাপ্রতিমা দেখতে হাজির হন অনেকে। মদনমোহন মন্দিরের কর্মী জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, বড়দেবী ও কাঠামিয়া মন্দিরে পুজো চলছে। প্রাচীন প্রথা মেনে সবরকম আয়োজন করা হয়েছে দুই মন্দিরে।
কোচবিহারের মহারাজাদের শুরু করা বড়দেবীর পুজো পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরনো বলে গবেষকরা দাবি করেন। অন্যান্য দুর্গাপুজোর সঙ্গে এই পুজোর প্রতিমার বিস্তর ফারাক। দেবীর সঙ্গে এখানে থাকেন জয়া ও বিজয়া। থাকে মহিষাসুর, বাঘ ও সিংহ। দেবীবাড়িতে বড়দেবীর মন্দিরেই প্রতিমা বানানো হয়। বড়দেবীর প্রতিমা ময়না কাঠ দিয়ে করা হয়। নির্দিষ্ট তিথিতে সেই কাঠ সংগ্রহ করে এনে পুজোপাঠ হয়। তিথি মেনে হনুমান দণ্ডকে সামনে রেখে মদনমোহন মন্দির থেকে ময়নাকাঠকে বড়দেবীর মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। এরপর তিনদিন হাওয়া খাওয়ানো হয় সেই কাঠকে। তারপর ট্রলিতে চাপিয়ে কাঠামো বেঁধে বড়দেবীর প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রেও বিধি রয়েছে। তুফানগঞ্জের চামটার নির্দিষ্ট জমিতে গিয়ে পুজো করে সেখান থেকে মাটি নিয়ে আসা হয়। সেই মাটি দিয়েই দেবীর মুখ বানানো হয়।
প্রতিমা তৈরি হয়ে গেলে নির্দিষ্ট তিথিতে দেবীর মুখদর্শন করা হয়। এই রীতিকে দেওদেখা বলা হয়। তামার প্রকাণ্ড কোষাকোষিতে রাখা জলে দেবীর মুখমণ্ডল দর্শন করেন জেলাশাসক। এবার জেলাশাসক অরবিন্দকুমার মিনা এই রীতি পালন করেছেন। সঙ্গে ছিলেন রাজ প্রতিনিধি হিসেবে দুয়ারবক্সি। এসবের মধ্যে দিয়েই পুজোর সূচনা হয়েছে বড়দেবীর। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও মহানবমীতে পুজো হবে। বড়দেবীর প্রতিমা যে ট্রলির উপর রাখা হয়েছে সেটি দশমীতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে স্থানীয় লম্বা দিঘিতে। সেখানেই প্রতিমা নিরঞ্জন হবে। বিসর্জনের দিনও নানা নিয়মাবলী রয়েছে। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই পুজো হয়। একই ভাবে কাঠামিয়া মন্দিরের পুজোও রাজ আমলের প্রাচীন নিয়মাবলী মেনেই করা হয়। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসা ঐতিহ্যবাহী বড়দেবী ও মদনমোহন মন্দিরে কাঠামিয়া মন্দিরের পুজোর গুরুত্ব তাই একেবারেই আলাদা।