সংবাদদাতা, বনগাঁ: মূর্তি তৈরির দালানঘর এখন ফাঁকা। গালে হাত দিয়ে বসে প্রদীপ ভট্টাচার্য। ঝোড়ো হাওয়া পাক খায় ঘরে। জমজমাট জায়গাটি শূন্য। ঘরজুড়ে মাটির গন্ধ। এ গন্ধ মাটির নয়, প্রদীপ জানে, এ তার মেয়ের শরীরের গন্ধ। তার তৈরি দুর্গার গন্ধ। মন হু হু করে। মহালয়ার পর থেকে মাইক বাজাচ্ছে পুজো কমিটি। আওয়াজ আসে আগমনির। ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী যাও তুমি কৈলাসে’। গিরি কাল সত্যি এল, দুর্গাকে নিয়ে চলে গেল। কৈলাসে শিবের মতো মনখারাপ করে বসে প্রদীপবাবু। বনগাঁর প্রদীপ থেকে কলকাতার কুমোরটুলির বাবু পাল। চন্দননগরের অধীর থেকে হাওড়ার বটকৃষ্ণ। সবার দুর্গা নিয়ে গিয়েছে গিরি। মণ্ডপে-বাড়িতে গিরিরানি মেয়েকে পেয়ে যত্নে যত্নে ভরিয়ে তুলছে। তখন প্রতিমা শিল্পীদের ফাঁকা ঘরে দুর্গার মাটির সুগন্ধ গ্রাস করে গিলে খেয়েছে মন খারাপের উগ্র গন্ধ। ফাঁকা ঘরে অবসন্ন শিল্পী। কয়েক মাসের খাটুনি আর ঘরের মেয়ে চলে যাওয়ার দুঃখে অবসন্ন। কাতর। ‘যাকে এতদিন ধরে সাজালাম তাকে ছাড়তে মন চায় না। তবু ছেড়ে দিতে হয়।’
বনগাঁর নামকরা মৃৎশিল্পীদের অন্যতম প্রদীপ ভট্টাচার্য। এবছর ২৫টির মতো প্রতিমা গড়েছেন। পঞ্চমীতে তাঁর তৈরি সব প্রতিমা মণ্ডপে চলে গিয়েছে। সপ্তমীর সকালে তাঁর বাড়ি নিস্তব্ধ। মনখারাপ। প্রদীপ বলেন, ‘সকলে মেয়েকে ছোট থেকে বড় করে। বিয়ের দিন সাজিয়ে শশুরবাড়িও পাঠায়। তা আনন্দের। বেদনারও। আমাদের জীবনটাও এক। কয়েক মাস ধরে যাকে সাজাই সে চলে গেলে মন খারাপ হবে না?’ দুর্গাকে শিল্পীর ঘর থেকে মণ্ডপে গিরিরাজের কাছে পৌঁছে দেন বিভূতি মণ্ডল, সাধন দাসরা। কেউ ন্যাজাট থেকে বনগাঁয় যান। কেউ মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় পৌঁছন। বনগাঁয় আঠারো জনের একটি দল এসে পটুয়াপাড়ায় অস্থায়ী ঠিকানা গড়েছেন। তাঁরা কাঁধে নিয়ে ঠাকুর পৌঁছে দেন মণ্ডপে। বিভূতি বলেন, ‘এ সময় বাড়তি আয়। সে আশায় ছুটে ছুটে আসি।’ সপ্তমীতে মাইকে বাজছে, কি শোনালে গিরিবর, উমা কি ভবনে এল…। মণ্ডপে তখন ভিড়। মানুষের ঢল। সে ভিড়ে মিশে প্রদীপরাও। তাঁদের মেয়ে আরও সেজেছে। গয়না পড়েছে। দেখে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। দুর্গার চোখে চোখ পড়ে প্রদীপের। মেয়ের চোখ কি হেসে উঠল একটু? খুশিতে চোখ জলে ভরে গেল প্রদীপের। ‘কাল আবার আসব। দেখা হবে’-বাড়ি ফিরল নামকরা প্রতিমা শিল্পী প্রদীপ। -নিজস্ব চিত্র