কলকাতার ট্রাফিক জ্যামে আটকে ট্যাক্সি না পেয়ে মারুতি ৮০০-তেই লিফট নিলেন রতন টাটা
এই সময় | ১০ অক্টোবর ২০২৪
জয়ন্ত সাউ|এই সময় অনলাইন এক্সক্লুসিভ
আজ থেকে ২৪ বছর আগের কথা। তারিখটা ৫ সেপ্টেম্বর, ২০০০। তখন আমি রয়টার্সের ফটোগ্রাফার। 'টাটা টি'-র শেয়ার হোল্ডারদের বিজ়নেস মিটিং ছিল কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে। আমাদের রিপোর্টার হিমাংশু ওয়াটস-এর সঙ্গে আমি গ্র্যান্ডে গিয়েছি সেই বিজ়নেস মিটিং কভার করতে। মিটিংয়ের ছবিটবি তুলে লাঞ্চের পরে বিকেল তিনটে নাগাদ আমরা গ্র্যান্ডের আউট গেটের ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে আছি।গেটটা বন্ধ। কারণ, বাইরে চৌরঙ্গী রোডে বামপন্থীদের কোনও একটা মিছিলের জেরে ব্যাপক যানজট।এতটাই জ্যাম যে, দীর্ঘক্ষণ কোনও গাড়িই নড়ছে না। আমরা ভাবছি কী ভাবে প্রেস ক্লাবে যাব, কারণ ওখানেই আমার সদ্য কেনা মারুতি-৮০০ গাড়িটা পার্ক করে এসেছি। এরই মধ্যে দেখি স্বয়ং রতন টাটা আউট গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। চোখে-মুখে কেমন যেন একটা অস্বস্তির ভাব। মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলতে-বলতে একবার পিছিয়ে যাচ্ছেন, একবার গেটের সামনে চলে আসছেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওঁর গাড়িটা হোটেলের পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে ওঁর ড্রাইভার গাড়ি বার করে চৌরঙ্গী রোডে যেতেই পারছেন না।
মিনিট পনেরো-কুড়ি ওই ভাবেই হোটেলের আউট গেটের কাছে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন দেশের প্রবাদপ্রতিম শিল্পপতি। কিছুক্ষণ পরেই দেখি দারোয়ানকে দিয়ে গেট খুলিয়ে রতন টাটা তাঁর এক সঙ্গীকে (সেক্রেটারিই ছিলেন বোধহয়) নিয়ে চৌরঙ্গী রোড ধরে জ্যামের মধ্যেই হাঁটা লাগিয়েছেন। এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি আর হিমাংশু ওঁদের পিছু নিলাম। কাছাকাছি পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম, 'হাঁটছেন কেন?' উনি বললেন, 'তাজ বেঙ্গলে জরুরি মিটিং রয়েছে। ট্যাক্সি ধরতে হবে।' একরকম যেচেই রতন টাটাকে পরামর্শ দিলাম, 'মনোহর দাস তড়াগের পাশ দিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে চলুন। ওখানে ট্যাক্সি পেতে সুবিধে হবে।' এ-ও বললাম, 'আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন। আমরাও ও দিকেই যাচ্ছি।'
এ সব বলতে-বলতে আমি রতন টাটার জ্যামের মধ্যে হাঁটার ছবি তুলছি। তা দেখে উনি খুবই ভদ্র স্বরে আমায় ছবি তুলতে বারণ করলেন। আমি ওঁর কথা মেনে আর ছবি তুললাম না। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় মনোহর দাস তড়াগের পাশ দিয়ে প্রেস ক্লাবে যাওয়ার রাস্তা খুবই ভাঙাচোরা ছিল। সেই রাস্তা ধরে আমরা প্রেস ক্লাবের দিকে এগোতে থাকলাম। প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে ওঁকে বললাম, 'রাস্তা পেরিয়েই ট্যাক্সি পাবেন।' ওঁরা গিয়েও কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন আমাদের কাছে। বুঝতে দেরি হলো না, রতন টাটা ট্যাক্সি পাননি। এবং এ-ও দেখলাম, উনি দারুণ হতাশ হয়ে পড়েছেন। আমি থাকতে না পেরে রতন টাটার কাছে জানতে চাইলাম, লিফট চাই কি না। নিমেষে উত্তেজিত গলায় জবাব, 'ইয়েস!
তড়িঘড়ি আমার গাড়ির দরজা খুলে হিমাংশুকে বললাম গাড়ি চালাতে, কারণ আমি পিছনে বলে রতন টাটার ছবি তুলব। চালকের আসনের পিছনে বসলাম আমি, আমার বাঁ দিকে উনি। হিমাংশুর পাশে টাটার সেক্রেটারি। গাড়ি চলতে চলতেই আমি রতন টাটার ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। উনিও দেখলাম আর বারণ করলেন না। তবে দেখলাম সেপ্টেম্বরের ভ্যাপসা গরমে বেশ ঘামছিলেন। আমায় জিজ্ঞেস করলেন, 'এই গাড়িটা কি এসি?' আমি বললাম, ‘না, এসি গাড়ি নয়।‘ উনি ফের জিজ্ঞেস বললেন, ‘এটা কী গাড়ি?' আমি বললাম, 'মারুতি ৮০০।' দুম করে আমাকে বলে বসলেন, 'টাটা ইন্ডিকা কেনো না কেন? টাটারও ভাল গাড়ি।'
এরই ফাঁকে হিমাংশু নিজের পরিচয় দিয়ে রতন টাটাকে প্রশ্ন করে বসল টাটাদের বিজ়নেস পলিসি নিয়ে। উনি খালি বললেন, 'তোমরা তো খুব চালাক দেখছি।' (অর্থাৎ, ফাঁকতালে একা পেয়ে সব জেনে নেওয়ার চেষ্টা!) গাড়ি একসময় পৌঁছল তাজ বেঙ্গলে। গাড়ি হোটেল ঢুকতেই টুপি-পরা দারোয়ান এগিয়ে এসে দরজা খুলতে এলেন। আর দরজা খুলেই ছিটকে পিছিয়ে গেলেন! মালিককে সে মারুতি গাড়িতে দেখবে ভাবতে পারেনি বোধহয়। যাই হোক, উনি আর ওঁর সেক্রেটারি গাড়ি থেকে নেমে আমাদের সঙ্গে কোনও কথা না বলে গটগট করে হোটেলের ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমরাও ফেরার পথ ধরলাম।
এর বেশ কয়েক বছর পরের কথা। মুম্বইয়ে তাজ হোটেলে জঙ্গি হামলা। ফটোগ্রাফার হিসেবে কভার করতে গিয়েছি। অপারেশন শেষ। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ এনএসজি কমান্ডোরা হোটেলে ঢুকে শেষ ছানবিন করছে। আমরা সারা রাত হোটেলের পিছনের দিকে ছিলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে ফটোগ্রাফার, রিপোর্টাররা হোটেলে ঢুকে পড়েছি। আমি নাগাড়ে ছবি তুলছি। হোটেলে ঢুকে কিছুটা এগোতেই দেখি রতন টাটা দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে। আমার সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল। দেখে মুচকি হাসলেন শুধু। আমিও তেমনই হেসে প্রত্যুত্তর দিলাম। সেই শেষ দেখা।