সিঙ্গুরে বামেদের ভুল জমি নীতির খেসারত দিতে হয়েছে টাটাদের!
প্রতিদিন | ১০ অক্টোবর ২০২৪
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর! টাটা গ্রুপের তরফে জানিয়ে দেওয়া হল, সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা হচ্ছে না। কৃষকদের চোখের জলে শস্যশ্যামলা উর্বর জমিতে কংক্রিটের কারখানা গড়া যে সম্ভব নয়, ততদিনে বুঝে গিয়েছেন বিচক্ষণ শিল্পপতি রতন টাটা। সেদিন টাটাদের বিদায়ে যুবসমাজের কর্মসংস্থানের স্বপ্নে ধাক্কা লেগেছিল ঠিকই, তবে আবাদি জমি কেড়ে শিল্পায়ন যে দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি আনতে পারে না, সেই সত্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবার প্রশ্ন, শিল্পয়ান কি আদৌ করা যেত না? বিকপ্ল ল্যান্ড ব্যাঙ্ক কি ছিল না? টাটাদের বিদায়ের দায় কার?
বামেরা বরাবরই সিঙ্গুরে ন্যানো বিদায়ের দায় নিজেদের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু বাস্তবটা অন্য। সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় দায় বামফ্রন্ট সরকারের ভ্রান্ত জমি নীতির। অন্তত সিঙ্গুরের অসন্তুষ্ট কৃষকরা তেমনটাই মনে করেন।
২০০৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এসেই টাটাকে সিঙ্গুরে ছোটো গাড়ি তৈরির জন্য জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সেই মতো রাজ্যের শিল্প উন্নয়ন নিগমের সঙ্গে টাটার চুক্তি হয়। সিঙ্গুরের বেরাবেড়ি, খাসেরভেড়ি, সিঙেরভেড়ি, বাজেমেলিয়া ও গোপালনগর মোট পাঁচটি মৌজার ৯৯৭ একর জমি চিহ্নিত করে অধিগ্রহণ করা হয়। সেই জমি অধিগ্রহণ হতেই শুরু হয় আন্দোলন। অনিচ্ছুক কৃষকরা দাবি করেন, তাঁদের উর্বর জমি এভাবে জোর করে নিয়ে নেওয়া যাবে না। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যান সিঙ্গুরের কৃষকরা। কারখানার কাজ প্রায় আশি শতাংশ শেষ হয়ে গেলেও পিছু হটে টাটা। ২০০৮ সালে সিঙ্গুর থেকে কারখানা গুটিয়ে গুজরাটে চলে যায়।
কেন জমি আন্দোলন? সমস্যা হল, যে যে এলাকার জমি কারখানার জন্য সনাক্ত করা হয়েছিল, সেই ৯৯৭ একর জমির সিংহভাগই তিন ফসলি, চার ফসলি। এমনকী অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার সময় যাঁদের জমি নেওয়া হচ্ছে সেই সব কৃষকদের পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়। সরকার কৃষকদের জমি নেবে, কিন্তু কর্মসংস্থানের কী হবে, কত টাকা ক্ষতিপূরণ মিলবে, এ সব ব্যাপারে কৃষকদের সঙ্গে আলোচনাই করা হয়নি। স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ভুল বুঝিয়েছিলেন। সিপিএমের ‘হার্মাদ’ বাহিনী একপ্রকার জোর করে জমি দখল করে। আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর নির্বিকারে গুলি চালিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশের আড়ালে কৃষকদের উপর নৃশংস হামলা চালানোর নেপথ্যে ছিল সিপিএমের হার্মাদ বাহিনীই। এসব সত্ত্বেও অধিগ্রহণ নিয়ে সরকারের অনড় একগুয়ে মনোভাবই আন্দোলনকারীদের জেদ বাড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত প্রবল প্রতিরোধে ফিরতে হয় টাটাদের।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনওই শিল্পের বিরোধী ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন, অনুর্বর জমিতে শিল্প হোক, আর অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়া হোক। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর মধ্যস্থতায় সরকার পক্ষ এবং বিরোধী শিবিরের একটি আলোচনা প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন, যারা ইচ্ছুক জমিদাতা, শিল্পের জন্য জমি দিয়েছেন তাঁদের জমিতে শিল্প হোক। সেটা প্রায় ৭০০ একর মতো। কিন্তু সে প্রস্তাব সিপিএম মানেনি। বুদ্ধবাবু পুরো জমিতেই কারখানা করার দাবিতে অনড় ছিলেন। বামেদের জমি অধিগ্রহণ নীতিতে যে ভুল ছিল, সেটা পরে মেনে নেয় সুপ্রিম কোর্টও। অধিগ্রহণ নীতি ভুল ছিল বলেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অনিচ্ছুক কৃষকরা জমি ফেরত পান। বুদ্ধবাবু যদি সেসময় অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দিয়ে ৭০০ একরে কারখানা করতে রাজি থাকলে সিঙ্গুরে শিল্প হত। ৯০ শতাংশ কাজও হয়ে গিয়েছিল।
তৃণমূল যে শিল্পায়ন বা টাটার বিরোধী নয়, সেটা ক্ষমতায় আসার পরও একাধিকবার বোঝা গিয়েছে। রাজ্যে পালাবদলের পর ২০১৪ সালে মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণেই রাজ্যে এসেছিলেন রতন টাটা। রাজ্যে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। তৃণমূল তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজে টাটাদের রাজ্যে বিনিয়োগে আমন্ত্রণ জানান। তিনি স্পষ্ট বলেন, “সিঙ্গুরের লড়াই টাটাদের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল বাম সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে। যে পদ্ধতিতে জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল, তা সঠিক ছিল না। টাটার সঙ্গে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই। টাটার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করিনি। আমরা টাটাকে কোনও দোষও দিইনি।” রতন টাটার প্রয়াণের পর তাই বঙ্গ যুবসমাজের ‘দুর্দশা’র জন্য যারা একচ্ছত্রভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিঁধে চলেছেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত সিঙ্গুরে টাটা বিদায়ের দায় সরকারের ভ্রান্ত নীতিরই।