২০০৬ সালের ১৮ মে। স্বপ্নের প্রকল্পের ঘোষণা করেন রতন টাটা। হুগলি জেলার সিঙ্গুরে তৈরি হবে ‘ন্যানো’ গাড়ির কারখানা। প্রকল্প ঘোষণার কয়েকিদন পর থেকেই শুরু হয় জমি আন্দোলন। ৯৯৭ একর জমির মধ্যে ৪০০ একর জমি নিয়ে শুরু হয় চরম বিরোধিতা। সিঙ্গুর আন্দোলনের গোটা পর্বের একদিকে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার, টাটা গোষ্ঠী ও তার কর্ণধার রতন টাটা, অন্যদিকে তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লাগাতার আন্দোলন। শেষে ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর থেকে প্রকল্প সরানোর ঘোষণা করেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা।সিঙ্গুর থেকে কারখানা সরিয়ে নেওয়ার পর কী বলেছিলেন তিনি? ফিরে দেখা যাক টাটা-র বিদায় পর্বের শেষ লগ্নে রতন টাটার বক্তব্যের বেশ কিছু অংশ।
কেন সরিয়ে নিতে হচ্ছে কারখানা? রতন টাটা বলেন, ‘আমাদের কাজের একটি টাইম লাইন রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মানুষের সামনে এই কাজ তুলে ধরার জন্য আমরা দায়বদ্ধ ছিলাম। তবে, আমরা বিশ্বাস করি না যে আমরা পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভবিষ্যতে অন্য প্রকল্পের জন্য পশ্চিমবঙ্গকে বেছে নেওয়া হবে।’
তৎকালীন সরকার ও বিরোধীদের সম্পর্কে কী বলেছিলেন তিনি? রতন টাটা বলেন, ‘বর্তমান সরকারের শিল্পবান্ধব নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে আমরা দু’বছর আগে এখানে এসেছিলাম। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের (তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী) নেতৃত্বের প্রতি আমাদের এখনও অনেক শ্রদ্ধা রয়েছে। আমরা যে দু’বছর কাজ করেছি, সরকার আমাদের যে সমর্থন দিয়েছে এবং তারা যে সুবিধা দিয়েছে তার জন্য আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। দুর্ভাগ্যবশত আমরা বিরোধীদলগুলির থেকে লাগাতার আন্দোলন এবং বড় আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়েছি। যা প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রকল্প সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।’
টাটার ন্যানো প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন রতন টাটাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমার মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি মাথা সরাব না।’ তবে, এই প্রকল্পের বিদায় বেলায় রতন টাটা সেই উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘দু’বছর আগে আমি বলেছিলাম, কেউ যদি আমার মাথায় বন্দুক ঠেকায়, তাহলেও আমি মাথা সরাব না। আমি মনে করি ট্রিগারেই চাপটা দিয়েছেন মিস ব্যানার্জি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কীভাবে উৎপাদন করব, যেখানে আমাদের বলা হয় যে আন্দোলন চলবে। মিস ব্যানার্জি যখন প্রকাশ্যে বলেন, যে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আমাদের চায় না, তখন আমরা কীভাবে কাজ চালিয়ে যাব? সুতরাং এই সমস্ত বিষয়গুলি একত্রিত করলেই বোঝা যায়, আমাদের কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ নেই।’
প্রকল্প সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে টাটা বলেন, ‘আমি অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক যেটা আমাদের অনেকের স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত যে এই প্রকল্পে যাঁরা শুরু থেকে কাজ করেছেন, তাঁদের জন্য এই সিদ্ধান্ত আরও হতাশাজনক। তবুও মনে করি, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আমাদের বিকল্প কিছু করার নেই।’
আজও, সিঙ্গুরের ৯৯৭ একর জমির ভবিষ্যত বদলায়নি। সিঙ্গুর কৃষি জমি রক্ষা কমিটির তৎকালীন সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, সিঙ্গুরের আন্দোলন টাটার বিরুদ্ধে ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের পুলিশি অত্যাচার ও জোর করে জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল এই আন্দোলন। সিঙ্গুরের বিধায়ক তথা মন্ত্রী বেচারাম মান্না বলেন, ‘সিঙ্গুরের জমি নিয়ে আন্দোলন ছিল। টাটার বিরুদ্ধে ছিল না। রাজ্যপাল (তৎকালীন) গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীর টেবিলে যে চুক্তি হয়েছিল তা মানেনি বাম সরকার।’