মিশুকে স্বভাবের অনিকেত ক্য়াম্পাসে বরাবরই সরব হয়েছেন বিভিন্ন দাবি তুলে
এই সময় | ১১ অক্টোবর ২০২৪
জয় সাহা
‘সংকটজনক’ অবস্থা থেকে অত্য়ন্ত ধীর গতিতে হলেও চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করেছেন অনশনরত জুনিয়র চিকিৎসক অনিকেত মাহাতো। এই মুহূর্তে আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসধীন তিনি। সামান্য হলেও গত রাতের চেয়ে অবস্থার উন্নতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। যদিও চিকিৎসকরা এখনই তাঁর শারীরিক অবস্থাকে ‘স্থিতিশীল’ বলতে চাইছেন না। এ দিকে, ছেলের অনশনের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ সমর্থন-করা অনিকেতের পরিবারের তরফে তাঁর বাবা অপূর্ব মাহাতো শুক্রবার কলকাতার পথে রওনা হয়েছেন।
এক বার স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষার খাতায় ৯৮-এর জায়গায় ভুল করে ৩৪ পড়ে যাওয়ার পর সোজা প্রধান শিক্ষকের ঘরে গিয়ে উপস্থিত-হওয়া অনিকেতের ব্য়ক্তি তথা ছাত্রজীবনের নানা দিক নিয়ে খোঁজ করল ‘এই সময় অনলাইন’।
স্কুল জীবন:প্রাথমিক: বিদ্যাসাগর শিশু শিক্ষা নিকেতন
মাধ্যমিক: রাধাচরণ বিদ্যামন্দির
উচ্চ মাধ্যমিক: কুমুদ কুমারী ইনস্টিটিউশন (কেকেআই ঝাড়গ্রাম বলে পরিচিত)
অনিকেতরা দুই ভাই-বোন। দিদি আছেন। তাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিনপুর দু’নম্বর ব্লকের সন্দাপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মুরারি গ্রামে অনিকেতের জন্ম ভিটে। বাবার অবসরের পর বাড়ি তৈরি করে শিলদাতেই ১০ বছর ধরে বসবাস অনিকেতদের।
এক বছর কলকাতায় কোচিং নেওয়ার পর ২০১২ সালে আইপিজিএমইআর-এসএসকেএম হাসপাতালে এমবিবিএস-এ ভর্তি হন অনিকেত। এই মুহূর্তে তিনি আরজি কর মেডিক্য়াল কলেজে অ্যানাসথেসিয়া বিভাগের তৃতীয় বর্ষের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া। অনিকেত যে বিভাগের ছাত্র, সেই আরজি করের অ্যানাসথেসিয়া বিভাগের প্রধান সোমা মুখোপাধ্যায়ই তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের দায়িত্বে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নানবিধ সামাজিক কাজকর্ম (যেমন মেডিক্য়াল ক্যাম্প অর্গ্য়ানাইজ় করা)-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন অনিকেত।
এর পর সক্রিয় বাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন অনিকেত। কলেজ থেকেই কমরেড শিবদাস ঘোষের আদর্শে অনুপ্রাণিত এসইউসিআই-এর ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র একনিষ্ঠ কর্মী রূপে নিজের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করেন অনিকেত। ইউনিভার্সিটি-সহ স্বাস্থ্য দপ্তরের নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার তিনি। কলেজ জীবনে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিবিধ দাবিদাওয়া তুলে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেন অনিকেত (কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে কেন হস্টেল থাকবে, সে ব্য়াপারে একাধিকবার ডেপুটেশন দেন)। হস্টেলের চূড়ান্ত অব্যবস্থা, পরীক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সরব হন। ২০১২ সাল থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে কলেজ হাসপাতাল ও হস্টেলে সার্বিক পরিকাঠামো তথা নিরাপত্তা গড়ে তোলার দাবিতে অনিকেতের সরব হওয়া সতীর্থদের প্রভাবিত করতে শুরু করে যথেষ্টই।
২০১৬ সালে আইপিজিএমইআর-এসএসকেএম (পিজি) হাসপাতালের এআইডিএসও ইউনিটের সেক্রেটারি হিসাবে নির্বাচিত হন ডাক্তার অনিকেত মাহাতো। ২০০৪ সালে কলেজের শুরু থেকে এআইডিএসও-র পিজি ইউনিট সম্পাদক ডাঃ গৌরাঙ্গ প্রামাণিক (যিনি আবার পিজি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন-এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক অর্থাৎ জিএস ছিলেন), ডাঃ কবিউল হক (দ্বিতীয় ইউনিট সম্পাদক) আর তৃতীয় ইউনিট সম্পাদক ডাঃ অনিকেত মাহাতো। আইপিজিএমইআর-এসএসকেএম হাসপাতালের প্রাক্তনী, এআইডিএসও পরিচালিত সর্বশেষ (২০১১) ছাত্র সংসদের কোষাধ্যক্ষ ও এআইডিএসও আইপিজিএমইআর-এসএসকেএম হাসপাতাল ইউনিটের ভূতপূর্ব ইউনিট সম্পাদক তথা ডাঃ কবিউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘অনুজপ্রতিম অনিকেত ২০১২ সালে যখন এসএসকেএমএ ভর্তি হতে আসেন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক। শুরু থেকেই অনিকেত মেডিক্য়াল ক্য়াম্প অর্গানাইজ় করা থেকে শুরু করে, ব্য়াচমেট এবং জুনিয়রদের নানাবিধ প্রয়োজনে সাহায্য়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেন অনিকেত। সেই সঙ্গে নানাবিধ সঙ্গত দাবি তুলে একের পর এক আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতে শুরু করেন তিনি। এ ভাবেই ধীরে-ধীরে তাঁর রাজনৈতিক মনোভাব গড়ে উঠেছিল।’
২০১১ সালের পর থেকে এখনও অর্থাৎ ২০১২ থেকে ২০২৪ এসএসকেএম-এ কোনও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। ২০১১ থেকে ২০১৫, দীর্ঘ ৪ বছর অনিকেত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য় লড়াই করেন। কলেজজীবনে অনিকেত এআইডিএসও-র নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, জানিয়েছেন ডাঃ কবিউল হক। নিজের কলেজ-সহ মেডিক্য়ালের নানা বিষয়ে আন্দোলনে পা মেলানো, কখনও সাড়ে তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স, কখনও রুরাল ইন্টার্নশিপ বা ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন গঠন করার প্রতিবাদে মিছিলেও শামিল হয়েছেন অনিকেত।
অত্য়ন্ত মিশুকে স্বভাবের অনিকেতের দ্রুত আরোগ্য় কামনায় তাঁর সহকর্মী থেকে শুরু করে জুনিয়র-সিনিয়র সকলে। অনশনে থাকাকালীন দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলেও চা-প্রিয় অনিকেত যে কী ভাবে এই ক’দিন চা না-খেয়ে রয়েছেন, তা-ও বিস্মিত করেছে অনেককে। খবর দেখতে এবং দেশ-বিদেশের খবর পড়তে ভালোবাসেন তিনি। সেই সঙ্গে মনীষীদের জীবনচর্চাও তাঁর ভীষণ প্রিয়। কলেজ-হস্টেলে নেতাজি, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, প্রীতিলতাদের স্মরণ দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতেন অনিকেত।