সংবাদদাতা, কাঁথি: একদিকে সংসার সামলানো, অন্যদিকে টোটোর স্টিয়ারিং। লোকের বাঁকা চাহনি, আড়ালে কটুক্তি। আরও অনেককিছু। সবই শক্ত হাতে সামাল দেন। টোটোচালক হিসেবে এভাবে ‘দশভুজা’ হয়ে উঠেছেন খেজুরির নিজকসবা গ্রাম পঞ্চায়েতের আলিপুর সংলগ্ন উত্তর বটতলা গ্রামের সুলেখা দাস। তিনি খেজুরি থানা এলাকার প্রথম মহিলা টোটোচালক। নিজকসবা পঞ্চায়েত সহ খেজুরির নানা প্রান্তে টোটো নিয়ে ঘোরেন সুলেখা। যেখানে যাত্রী পরিবহণের প্রয়োজন, সেখানে যান। সব বাধাকে উপেক্ষা করে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবন সংগ্রামে এভাবেই এগিয়ে চলেছেন ৩৫ বছর বয়সি সুলেখা। অনেকেই সুলেখার লড়াই করে বাঁচার মনোভাবকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, মহাষ্টমীর দিন খেজুরির কামারদার ‘যুগের যাত্রী’ ক্লাব সুলেখা সহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কয়েকজন লড়াকু মহিলাকে ‘দশভুজা’ সম্মানে সম্মানিত করল। টোটো চালানো শুরু ছ’ বছর আগে। সমস্ত টোটোচালক যেখানে পুরুষ, সেখানে একজন মহিলা হয়ে কী করে টোটো চালাবে? ‘কয়েকদিন যেতে দাও, তারপর এমনিই আসা বন্ধ হয়ে যাবে’। সদ্য সহকর্মী হওয়া পুরুষ টোটোচালক, স্থানীয় লোকজন থেকে মায় প্যাসেঞ্জার, এরকম কতজনের কত কথা আর বাঁকা চাহনি সইতে হয়েছে। তবু একটুও দমে যাননি সুলেখা। এখন পুরুষদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে টোটো চালান তিনি।
উত্তর বটতলা গ্রামের ভাগ্যধর দাসের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সুলেখা। আজ থেকে এক দশকেরও বেশি আগে বিয়ে হয়েছিল পার্শ্ববর্তী গরানিয়া গ্রামে। কিন্তু বিধি বাম। স্বামী সহ শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে এক বছরের মধ্যে বাপের বাড়ি ফিরে আসেন। অভাবী দাদাদের সংসারে বোঝা না হয়ে বাবা-মা’কে বুঝিয়ে আলিপুর বাজারে পানের দোকান দেন। সেই দোকান বেশিদিন চলেনি। স্থানীয় কিছু মহিলার সঙ্গে এলাচ তোলার কাজে পাড়ি দেন কেরলে। কয়েকবছর কাজ করে কিছু টাকাপয়সা রোজগার করে সেখান থেকে ফিরে আসেন। তখন ২০১৮ সাল। হাতে সেভাবে কিছু কাজ ছিল না। সেই সময় টোটো চালানোর ভাবনা মাথায় চেপে বসে সুলেখার। সিদ্ধান্ত নেন, টোটো চালাবেনই। বাবার পরামর্শে টাকাপয়সা জোগাড় করে টোটো কেনেন। সেই শুরু। এখন সকাল হলেই বেরিয়ে যান। দুপুরে বাড়ি এসে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়া। বাবার দেওয়া একচিলতে জায়গায় ছোট্ট বাড়ি তৈরি করেছেন। ভাইয়েদের সংসারে থাকেন না। বাবা ভাগ্যধর ও মা সিদ্ধিরানিকে নিয়েই থাকেন সুলেখা। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যা রোজগার হয়, তাতে তিনজনের দিব্যি চলে যায়।
রসুলপুর নদীর তীরে বোগাঘাটে টোটো নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা সুলেখার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। জীবনের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ উঠতে সুলেখা বললেন, হৃদয়কে পাষাণ করে নিয়েছি। নতুন করে আর স্বপ্ন দেখতে চাই না। আমি যখন টোটো চালানো শুরু করি, প্রথমে আমাকে কেউ মেনে নিতে পারেনি। আমিও জায়গা ছাড়তে নারাজ। সময়ের সঙ্গে সবটাই মানিয়ে নিয়েছি। এখন সকলেই সহযোগিতা করেন। কারও কোনও কথার উত্তর দেওয়াটাকে আর ভয় পাই না। মানুষের বাঁকা নজর আজ আমার চলার পাথেয়। এভাবেই চলতে চাই। খেজুরির শ্যামপুর-কটকার বাসিন্দা কবি ভোলানাথ পাল বলেন, সুলেখা দশভুজার মতো সবকিছু সামাল দেন। অনেক কষ্ট করে রোজগার করেন। ওঁর লড়াইকে সম্মান জানাই। তিনি যেন জ্যান্ত দুর্গা।-নিজস্ব চিত্র