• বিষ্ণুপুর শহরে দুর্গাকে বিদায়ের বিষাদ দূর করে রাবণকাটা উৎসব
    বর্তমান | ১৫ অক্টোবর ২০২৪
  • সংবাদদাতা, বিষ্ণুপুর: দশমীতে উমার বিদায়ের সঙ্গে মন খারাপের পালা শুরু হয়ে যায় বাঙালির। তবে বিষ্ণুপুর শহরে তেমনটা হয় না। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের রেশ বজায় থাকে তারপরেও। রাবণকাটা উৎসবকে কেন্দ্র করে নতুন করে উন্মাদনায় মেতে ওঠেন বাসিন্দারা। শহরে প্রায় ২০০ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই লোক উৎসব  চলে আসছে। বিজয়ার দিন তা শুরু হয়। চলে দ্বাদশী পর্যন্ত। প্রথম দু’দিন ইন্দ্রজিৎ ও কুম্ভকর্ণকে বধ করা হয়। সোমবার শেষ দিনে রাবণকে বধ করা হয়। প্রথম দু’দিন দর্শনার্থীদের ভিড় কম হলেও রাবণবধের দৃশ্য দেখতে এদিন সন্ধ্যায় শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউর মন্দির প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে।  কী এই রাবণকাটা উৎসব? লোকশিল্পীরা পালার আকারে সাজিয়ে ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ ও রাবণকে বধ করেন। প্রথা অনুযায়ী জাম্বুবানের নির্দেশে হনুমান দশমী, একাদশী ও দ্বাদশীতে পর্যায়ক্রমে ইন্দ্রজিৎ, কুম্ভকর্ণ ও রাবণের গলায় তলোয়ারের কোপ মারে। উৎসবে ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্র রঘুনাথ জিউয়ের মন্দিরে সারাবছর ধরে রাখা থাকে। দশমীর দিন রাতে ওই অস্ত্র বের করা হয়। ওইদিন বিকটদর্শন কাঠের মুখোশ পরে সেজে ওঠে বিভীষণ, জাম্বুবান, হনুমান ও সুগ্রীব। এরপর তারা নানা রকম বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরের নিমতলা, মনসাতলা, মল্লেশ্বর, কালীতলা ও মহাপাত্রপাড়া ঘুরে বেড়ান। পরে দশমীর রাতে ইন্দ্রজিৎ বধ হয়। 


    একইভাবে একাদশীতে নাচ শেষে কুম্ভকর্ণ বধের পালা তুলে ধরেন শিল্পীরা। সোমবার দ্বাদশীতে রাবণ বধের মাধ্যমে উৎসব সম্পূর্ণ হয়। এদিন  শিল্পীরা হনুমানের সাজে সজ্জিত হয়ে সকাল থেকে শহরের তিলবাড়ি, গড়দরজা প্রভৃতি এলাকার বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরে বেড়ান। পরে সন্ধ্যার পর রাবণ বধের পালা শুরু হয়। প্রথা অনুযায়ী বধের আগে রামচন্দ্র তিনবার রঘুনাথ জিউয়ের কাছে যান। তারপর জাম্বুবানের অনুমতি নিয়ে মাটির রাবণ মূর্তিকে বধ করেন। বধের পর শুরু হয় হনুমানদের উল্লাস। তিনদিনের উৎসব হলেও সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় দ্বাদশীতে রাবণবধের দিনে। প্রতি বছর রাবণবধের দৃশ্য দেখতে শহরের কাটানধারে দর্শনার্থীর ভিড় উপচে পড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 


    কথিত রয়েছে, আনুমানিক ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহের আমলে রাবণকাটা লোকসংস্কৃতির প্রচলন হয়। মল্লরাজাদের তৈরি রঘথুনাথ জিউ মন্দিরে এই নাচ হতো। বিষ্ণুপুরের বেশ কিছু পরিবার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে বংশ পরম্পরায় আজও ওই নাচ করেন।  প্রায় ২০০বছরের পুরনো এই নাচের সঙ্গে মল্লরাজাদের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। বর্তমানে বিষ্ণুপুরের লোকশিল্প হিসেবে রাবণকাটা নাচ এখনও বেশ জনপ্রিয়। রাবণকাটা শিল্পীরা বলেন, এই নাচ মল্লরাজাদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। প্রত্যেক শিল্পী সারাবছর অন্যান্য পেশায় যুক্ত থাকেন। তবে যে যেখানেই থাকুক না কেন, দশমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত আমরা রাবণকাটা নাচে শামিল হই। পুরাণের নানা চরিত্রের সঙ্গে মানান সই পোশাক গায়ে জড়ালেই মনের মধ্যে এক আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়। তখন আমরা অন্য জগতে প্রবেশ করি। বংশ পরম্পরায় এই নাচ দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিতে পেরে আমরা ভীষণ খুশি হই।
  • Link to this news (বর্তমান)