• লাশকাটা ছেড়ে মা লক্ষ্মীর বাহক ভাগ্য বদলায় না কাটোয়ার বধূ ডলির
    বর্তমান | ১৬ অক্টোবর ২০২৪
  • সংবাদদাতা, কাটোয়া: কোলের শিশুর দুধের দাম জোগাড় করতে লাশকাটা ঘরের কাজ নিয়েছিলেন তিনি। তারপর  টানা পঁয়ত্রিশ বছর ভ্যানে করে দেহ বহন করেছেন। এখন স্বামী অসুস্থ। ওষুধের খরচ জোগাতে ভ্যানে করে লক্ষ্মী প্রতিমা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন কাটোয়ার বধূ ডলি দে। তাঁর এই জীবন-যুদ্ধকে কুর্নিশ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

    কাটোয়া শহরের পালপাড়া এলাকায় ভ্যান চালান ডলিদেবী। একটা লক্ষ্মী প্রতিমা ভ্যানে চাপিয়ে শহরের যে কোনও জায়গায় পৌঁছে দিতে পারলেই মেলে মাত্র পঞ্চাশ টাকা। সেই টাকা নিয়ে গেলে বাড়ির উনুনে হাঁড়ি বসে। যেদিন জোটে না, সেদিন বসে না। বসলেও স্রেফ নুন ভাত। সব্জি, মাছ কেনার পয়সা থাকে না। 

    কাটোয়ার চাউলপট্টী এলাকায় বাড়ি ডলিদেবীর। স্বামীর নাম সেন্টু দে। বিয়ের পর থেকেই অভাবের সঙ্গে লড়াই তাঁর। মর্গের কাজ নিয়ে হাল ধরেছিলেন সংসারের। তারপর এক ছেলে ও এক মেয়ে হয় দে দম্পতির। লাশ কেটেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন নাতি-নাতনিদেরও পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন ভ্যান চালিয়েই। ভাগ্যের চাকা আর কিছুতেই ঘুরছে না তাঁর! ডলিদেবী জানিয়েছেন, তখন কোলে দু’ বছরের ছেলে। দুধের দাম জোগাড় করতে হিমশিম অবস্থা। স্বামীও ভ্যান চালান। সারাদিনে তিনি যা উপার্জন করেন, তাতে ছেলের দুধ কেনা সম্ভব ছিল না। হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন একটা কাজের। পেয়েও যান। তবে, সেই কাজ মোটেও সহজ ছিল না। লাশ বহন করে আনতে হবে মর্গে। সেই লাশ কেটে ময়নাতদন্তে সাহায্যে করতে হবে। তাঁর কথায়, ‘সেদিন আমার আর কোনও উপায় ছিল না। প্রথম দিন লাশ কেটে এসে বাড়িতে ভাত খেতে পারিনি। সারাদিন বমি করেছি। সব রুচি সেদিন বদলে গিয়েছিল ছোট্ট ছেলেটার খিদের কান্নায়। ছিন্ন ভিন্ন লাশ ভ্যানে করে স্বামীর পাশাপাশি আমিও মর্গে নিয়ে এসেছি। বিনিময়ে ৩২৫ টাকা মিলত। তাই দিয়েই সংসার চালিয়েছি।’

    কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মর্গের কাজ আর পারছিলেন স্বামী-স্ত্রী। ২০২২ কাজ ছেড়ে দেন। তারপর থেকেই স্বামীর শরীরে নানা অসুখ বাসা বেঁধেছে। তিনি আর কোনও কাজ করতে পারেন না। তার উপর স্বামীর ওষুধের খরচ।  এমন অবস্থায় কুমোরপাড়া থেকে প্রতিমা বহনের কাজ করছেন ডলিদেবী। সেন্টু দে বলছিলেন, ‘আমার স্ত্রী আমার কাছে লক্ষ্মী। আমার স্ত্রী ঘেন্না, লজ্জা ত্যাগ করে লাশকাটা ঘরে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন।’ স্বামীর কথা থামিয়ে ডলিদেবীর সংযোজন, ‘একদিন একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে বিষ খেয়ে মারা গিয়েছিল। তার দেহ কাটতে হয়েছিল আমাকে। তখন আমার মনের যে কী অবস্থা হয়েছিল, সে একমাত্র আমিই জানি। দেহটার দিকে তাকালেই আমার ছেলের কথাও মনে পড়ে যেত। কিন্তু, ওই যে খিদের জ্বালা! তাকে সামলানোর সাধ্যি আমার ছিল না। তাই মনে মনে সান্ত্বনা খুঁজতাম এই ভেবে কোনও কাজই ছোট নয়। সব পেশাকেই সন্মান জানানো উচিত। আমি নিজেও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি। অনেক স্বপ্ন ছিল জীবনে। কিন্তু লাশকাটা ঘরেই যে আমার ভাগ্য লেখা ছিল, তা কি আগে জানতাম। এখন মা লক্ষ্মীর প্রতিমা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। মা লক্ষ্মী যেন এবার আমার দিকেও তাকান,  সেই কামনা করি।’
  • Link to this news (বর্তমান)