• আজ ও কাল ডাকলক্ষ্মীর আরাধনা উঃ দিনাজপুরে, প্রাচীন পরম্পরা মেনে পুজো
    বর্তমান | ১৭ অক্টোবর ২০২৪
  • নিজস্ব প্রতিনিধি, রায়গঞ্জ: ঘরে বসে নয়, একেবারে ভিন্ন উপাচারে খোলা আকাশের নীচে ধান খেত থেকে আহ্বান জানানো হয় দেবী লক্ষ্মীকে। উত্তর দিনাজপুরের বহু গ্রামে এমনই পুজো প্রসিদ্ধ ‘ডাকলক্ষ্মী’ নামে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সময় প্রাচীনকাল থেকেই এই ডাকলক্ষ্মীর পুজোর প্রচলন রয়েছে রাজবংশী সমাজে। এবারও তাঁরই আরাধনায় মেতে উঠতে চলেছে হেমতাবাদ, কালিয়াগঞ্জ, চোপড়ার বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা।  

    উত্তরবঙ্গের ইতিহাস পর্যবেক্ষকদের মতে, মূলত পরম্পরা মেনে বাংলার আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি বা কার্তিক মাসের পয়লা তারিখে এই পুজোয় মাতেন গ্রামীণ এলাকার রাজবংশীরা। পুজোর দিন কাকভোরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে লক্ষ্মীর আহ্বান শুরু করেন ভক্তরা। এরপর যে যার ধান খেতে যান। সেখানে আটা, কলা, দুধের একটি মিশ্রণ তৈরি করে খেতের ধারে পুজো শুরু করেন। সঙ্গে শ্লোক ষোড়শোরই হাঁসের ডিমা, কচুরপতি আয়রে নক্ষ্মী হামার বাড়ি...। এরই মাঝে পুজোর উপাচার হিসেবে হয় হাঁসবলি। কেউ আবার পুজোয় হাঁসের ডিম প্রদান করে থাকেন। 

    এবারও কালিয়াগঞ্জের ধনকৈলের গোবিন্দপুর, গণেশবাটি এলাকায় ডাকলক্ষ্মী পুজোর জোরদার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বুধবার গ্রামের বাসিন্দারা ধান খেতে তাঁরা পুজোস্থল নির্ধারণ করেন। অনেকেই হাট বাজার থেকে বলি দেওয়ার হাঁসও জোগাড় করে রেখেছেন আগেভাগেই। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, আমাদের ডাকলক্ষ্মী শুধু ধন সম্পদের দেবী নন, তিনি পোকামাকড় থেকে ফসল রক্ষা করে থাকেন। তাঁর কৃপায় খেত ভর্তি সোনার ফসল ঘরে তুলতে পারি আমরা। 

    গোবিন্দপুর, গণেশবাটি এলাকার বাসিন্দা দীনেশ বর্মন, রুমি বর্মন, কল্যাণচন্দ্র সরকার, কমলা বর্মনরা বলেন, দীর্ঘবছর ধরে পূর্বপুরুষের রীতি মেনে এই পুজো গ্রামের সিংহভাগ মানুষ করে আসছেন। যেহেতু আমরা পুজোর মাধ্যমে দেবী লক্ষ্মীকে গৃহে আহ্বান করি, ডাকি, তাই এই পুজো ‘ডাকলক্ষ্মী’ নামে সুপরিচিত। দেবীর সন্তুষ্টির জন্য হয় হাঁসবলি। যাঁরা হাঁস জোগাড় করতে পারেন না, তাঁরা পুজোয় হাঁসের ডিমও প্রদান করে। আমাদের ঘরে ঘটলক্ষ্মী পুজো হয়। গৃহের বাইরে ধান ক্ষেতে ডাকলক্ষ্মীর পুজো হয়। পরে সেই হাঁস প্রসাদ হিসেবে রান্না হয়। 

    এই প্রসঙ্গে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীপককুমার রায় বলেন, সর্বত্র লক্ষ্মীপুজো হয়, লক্ষ্মীপুজোর দিনে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজে লক্ষ্মীপুজো হয় সংক্রান্তির দিনে। একবারে ভিন্নস্বাদে। এটা শুধু উত্তর দিনাজপুর নয়, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার গ্রামীণ রাজবংশী এই পুজোর প্রচলন আজও আছে।

    এখানে আগে মূর্তিপুজোর প্রচলন ছিল না। ধানের গোছকে লক্ষ্মীরূপে পুজো করা হয়ে থাকে। যদিও এদের মধ্যে শহরমুখী অনেকেই নানা কারণে মূর্তি পুজো করছেন। কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, চোপড়া কুশমুণ্ডিতে ডাকলক্ষ্মীর পুজো হয় হাঁস বলি দিয়ে। ড: গিরিজাশঙ্কর রায়, ড: চারুচন্দ্র সান্যাল বিভিন্ন জায়গায় সে কথা উল্লেখ করেছেন। সেই পরম্পরা এখনও আছে। আসলে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন জনজাতির প্রত্যেকের পৃথক পৃথক উপাচারের মাধ্যমে লক্ষ্মীর আরাধনা করে এসেছে। রাভা জনজাতির মধ্যেও সংক্রান্তিতে লক্ষ্মীপুজোর প্রচলন রয়েছে। 
  • Link to this news (বর্তমান)