সেই লক্ষ্যে শুরু হওয়া আন্দোলনে সময়ের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে আরও দাবিদাওয়া। যা অবশ্যই সরকারি ক্ষেত্রে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি সনদের এক নম্বরে থাকা ‘ন্যায় বিচার’-এর বিষয়টি শেষের দিকে চলে যাচ্ছে না তো? প্রশ্ন উঠছে চিকিৎসক মহলের একাংশেই।
সিবিআইয়ের চার্জশিটে অনাস্থা জানিয়ে রাজ্যপালকে যাঁরা স্মারকলিপি দিতে যান, সেই জুনিয়র চিকিৎসকদের আইনজীবীই মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে খুন ও ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে কার্যত তেমন কিছুই বললেন না কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে সিনিয়রদের একাংশের মনে। দেখা গিয়েছে, গত শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টে সব সমস্যার মূলে বলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন জুনিয়র চিকিৎসকদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ। ফলে নির্যাতিতার বিচারের দাবি এক নম্বর থেকে ১১ নম্বরে চলে আসছে কি না, তা নিয়ে সংশয়ী সাধারণ মানুষের একাংশও। সিবিআই তদন্তে তাঁদের ‘অনাস্থা’ তৈরি হওয়া সত্ত্বেও আদালতে আইনজীবী কোনও প্রশ্ন তুললেন না কেন? আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা জুনিয়র চিকিৎসক সত্যদীপ সরকারের কথায়, “উনি অত্যন্ত সিনিয়র আইনজীবী। তাই কী বলবেন বা বলবেন না সেটা উনি নিজের মতো করে ঠিক করছেন। তবে সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে কেন কিছু বললেন না তা নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে।”
জুনিয়রদের সমর্থক সিনিয়র ডাক্তারদের অনেকেই এখন বলছেন, ১৪ অগস্ট রাতে যাঁরা রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁদের সবার একটাই দাবি ছিল— ন্যায়বিচার। কিন্তু এখন সিনিয়র ডাক্তারদের একাংশের কথায়, “জুনিয়রদের দাবি নিয়ে আমরাও সহমত। কিন্তু সেগুলি নিয়ে তো আন্দোলন শুরু হয়নি। সাধারণ মানুষ কিন্তু শুধু এক নম্বর দাবির উত্তর চাইতে রাস্তায় নেমেছিলেন। আজও তা-ই চাইছেন।”
কিন্তু শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধ্বনি তুললেই তো হবে না। কোর্টের সওয়ালেও তার প্রতিফলন হওয়া উচিত। কিন্তু তার বদলে প্রাধান্য পাচ্ছে নির্বাচন। সুপ্রিম কোর্টে ইন্দিরা জয়সিংহ যুক্তি দিয়েছেন, ২০২২-এর পর থেকে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। মনোনীত পড়ুয়াদের ছাত্র সংসদে বিভিন্ন পদে বসানো হচ্ছে। তাতেই হুমকি প্রথা চলছে এবং এর ফলেই আর জি করের ঘটনা ঘটেছে। আইনজীবীর যুক্তিকে মান্যতা দিলেও, সিনিয়র ডাক্তারদের একাংশের ব্যাখ্যা, আইনজীবীদের মামলা লড়ার নিজস্ব পন্থা এবং কৌশল থাকবেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে হতেই পারে, সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে এখনও আদালতে প্রশ্ন না তোলার অর্থ, সিবিআইয়ের চার্জশিট (যেখানে শুধু সঞ্জয় রায়কে অভিযুক্ত হিসেবে আপাতত লেখা হয়েছে) মেনে নেওয়া। তা হলে তো হুমকি প্রথার অভিযোগই খাটে না। আর যদি সঞ্জয়কে একমাত্র অভিযুক্ত হিসেবে মেনে নেওয়া না হয়, তা হলে ন্যায়বিচারের আন্দোলন সেই পথেই চালিত হওয়া উচিত। কিন্তু সেই লক্ষ্য কি দেখা যাচ্ছে? তথ্যপ্রমাণ লোপাটের বিষয়ে প্রথম চার্জশিটে সিবিআই কেন অভিযুক্তদের সম্পর্কে কিছু বলল না, গত শুনানিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের আইনজীবীরা কার্যত তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি সুপ্রিম কোর্টে।
যদিও, জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি, তাঁদের অনশন কর্মসূচিতে ন্যায়বিচারের দাবি অন্যতম। এই বিষয়ে সই সংগ্রহও শুরু হয়েছে। কিন্তু বহু সময়েই যে ভিড় অনশন মঞ্চ ঘিরে রাখছে, তাঁরা ন্যায়বিচার চাওয়ার বদলে স্লোগান তুলছেন শুধু ‘চোদ্দোতলা’ (নবান্নে ওই তলে বসেন মুখ্যমন্ত্রী)-র বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘নিস্পৃহতা’র অভিযোগ তুলেও সিনিয়র চিকিৎসকদের ওই অংশ এ-ও বলছেন, ন্যায়বিচার ও তদন্তের ভার এখন রাজ্য সরকারের হাতে নেই। তা হলে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ন্যায়বিচারের দাবির আন্দোলনে রাজনৈতিক স্বার্থের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যে কারণে কর্মবিরতি প্রত্যাহার বা অনশন নিয়েও মতভেদের চোরাস্রোত দেখা যাচ্ছে। তবে জুনিয়র চিকিৎসকেরা সবসময়েই প্রকাশ্যে বলছেন, ‘আমাদের আন্দোলন অদলীয় ও অরাজনৈতিক।’
প্রাক্তন সিনিয়র চিকিৎসকদের একাংশ এ-ও বলছেন, “স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সমস্ত কিছুতেই প্রবল দুর্নীতি হয়েছে, সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তা হলে তো সুষ্ঠু পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করাও অন্যতম দাবি হওয়া উচিত ছিল। আর, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ গঠিত হলেই সব সমস্যা মিটে যাবে?” তাই অনেকেরই প্রশ্ন, জুনিয়রদের আন্দোলনে তাঁদের অজানতে এমন কোনও ফাঁক বড় হচ্ছে না তো, যা দিয়ে রাজনীতি ঢুকতে শুরু করেছে। যাতে, ক্রমশ তলিয়ে যেতে বসেছে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।